–কেন কী হয়েছে? হিলারী জিজ্ঞেস করলো।
সে বললো, প্লেনটা নামার সময় হুমড়ি খেয়ে পড়ে চুরমার হয়ে গেছে। প্রায় সবাই মারা গেছে। চার-পাঁচজন যারা বেঁচে আছেন তাদের সবাই হাসপাতালে আছে, তাদের অবস্থা খুব খারাপ।
হিলারী চিন্তা করতে শুরু করলো, কেন আমি ঐ প্লেনে গেলাম না? গেলে–এতক্ষণে সব শেষ হয়ে যেতো–নিশ্চয়ই আমি মারা যেতাম, সব যন্ত্রণার সমাপ্তি ঘটতে। কেন-কেন গেলাম না আমি?
ক্যাসাব্লাঙ্কায় নেমে সে হোটেলে এলো। সে যেমনটি কল্পনা করেছিলো সেইরকমই হলো।
শোবার ঘরের জানালাটা হাট করে দিয়ে সে রাস্তা দেখাতে লাগলো। হ্যাঁ, এমনটাই সে কল্পনা করেছিলো। মুক্তি, মুক্তি ইংল্যান্ড ছেড়ে আসার পর থেকে মনের মধ্যে এই সুরেরই গুঞ্জরণ চলছিলো। কিন্তু ঠিক তার পরমুহূর্তেই মনে হল মুক্তি মুক্তির কোনো পথই নেই তার। সত্যিই তো, ইংল্যান্ডের মতো এখানেও সবকিছুই রয়েছে। সে নিজে হিলারী ক্র্যাভেনই রয়েছে। কী করে ভাবলাম ইংল্যান্ড থেকে দূরে কোথাও গেলেই আমার মন, আমার চিন্তা, আমার অনুভূতি–সব বদলে যাবে।
সেই ছোট্ট ঢিবিটা ব্রেন্দার কবর–সেটা ইংল্যান্ডেই রয়েছে। আর নাইজেল তার স্ত্রীকে বিয়ে করবে–ইংল্যান্ডেই। সে জীবনে অনেক কিছুই সহ্য করেছে কারণ তখনও ব্রেন্দা বেঁচেছিলো। ব্রেন্দার জন্যই সে সবকিছু সহ্য করেছে। অতীতকে ভুলে গিয়ে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎকে নিয়ে থাকবে বলে আশা করে এতদূর মরক্কোতে এসেছে। অতীত যেন তার পেছনে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার থেকে মুক্তির আর কোনো পথ নেই।
যদি ঘনকুয়াশা পথ আড়াল করে না দাঁড়াত, যদি তার নির্দিষ্ট বিমান না আসতো, এতক্ষণে তাহলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো৷ এতক্ষণে সে হয়তো সরকারী মর্গে শায়িত থাকতো। একই পরিণতি সে নিজেও ঘটাতে পারে, শুধু একটু কষ্ট করতে হবে এই যা। শুধু একটু ঘুমের বড়ি থাকলে কাজটা অনেক সহজ হতে পারতো। এক্ষুনি সে যাবে ওষুধের দোকান খুঁজে বের করবে। চারটে দোকান ঘুরে ঘুরে ঘুমের বড়ি নিয়ে সে হোটেলে ফিরে এলো।
হোটেলে ফিরে পোশাক পালটে নৈশাহারে যাবার সময় হিলারীর নিজেকে বেশ হাল্কা মনে হচ্ছিল।
হিলারী একরাশ দামি খাবার আর আধবোতল মদ আনতে বলে চুপ করে বসে রইলো। কেমন যেন এক অদ্ভুত উত্তেজনা অনুভব করছিলো সে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিচারক জলের বোতল এনে শুভরাত্রি জানিয়ে চলে গেলো। দরজায় চাবি লাগিয়ে দেরাজ খুলে ঔষধের বড়িগুলো নিল এবং গ্লাসে জল ভরে নিল। এবার যেন তার একটু ভয় ভয় লাগছিল কিন্তু ভয়টাও সুখের। এতদিনে সে মুক্তির স্বাদ পেতে চলেছে।
হাত বাড়িয়ে সে যখন প্রথম বড়িটা খেতে যাবে তখনই দরজায় টোকা পড়লো। সে বসে রইলো। দ্বিতীয়বার টোকা দেবার পরও হিলারী বসে রইল। তারপর সে দেখলো দরজার চাবিটা উল্টো দিক থেকে ঘুরছে। দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে যেতে লাগলো। তারপর দেখলো সে, ও যখন দোকানে ঔষধ কিনতে গিয়েছিল তখন সে একজন পেঁচামুখো লোককে দেখেছিল। এখন সেই ভদ্রলোকটিই ঘরে ঢুকলেন। এগিয়ে এসে হিলারীর সামনে এসে বললেন, আমার নাম জেসপ।
হিলারী রেগে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে আপনার কী প্রয়োজন, জিজ্ঞেস করতে পারি?
জেসপ বললেন, ভারি মজার কথা, আমিও আপনাকে ঠিক ঐ প্রশ্নটা করতে এসেছিলাম। ইঙ্গিতে তিনি ঔষধগুলোকে দেখালেন।
হিলারী চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। চোখ দুটো সরু করে, জোর করে একটু হাসি টেনে আনলো মুখে। কী অদ্ভুত লোক আপনি–ভাবছেন, আমি আত্মহত্যা-টত্যা করতে যাচ্ছিলাম।
-শুধু ভাবছি না, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
-আপনি আমাকে আত্মহত্যা থেকে আটকাতে পারেন কিন্তু আগামীকাল বা পরশু যদি আমি কিছু করতে চাই তবে কি আপনি আমাকে আটকাতে পারবেন? আমার বাঁচার কোনো আকষণই নেই।
জেসপ বললেন, বেশ মজার ব্যাপার।
হিলারী বলেন, মোটেই মজার নয়। আমার স্বামী, যাকে আমি ভালোবাসতাম, সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমার একমাত্র সন্তান-ম্যানেনজাইটিসে ভুগে মারা গেলো। আমার কেউ নেই। আমি কার জন্য বেঁচে থাকবো। আত্মহত্যা সম্পর্কিত অনেক কথা হওয়ার পর জেসপ আসল কথায় আসলেন। জেসপ বলতে শুরু করলেন হিলারীকে, আপনি নিশ্চয় দৈনিক সংবাদপত্র পড়েন। মাঝে মাঝেই হয়তো বিভিন্ন বিজ্ঞানীর উধাও হওয়ার খবর পড়ে থাকবেন। মাস ছয়েক আগে টমাস বেটারটন নামে এক বিজ্ঞানী উধাও হন।
হিলারী বললো, হ্যাঁ, খবরটা কাগজে পড়েছিলাম।
জেসপ বলতে লাগলো, খবরের কাগজের চেয়ে অনেক বেশি খবর আমাদের কাছে আছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ রসায়নশাস্ত্রের গবেষক, কেউ হয়তো পদার্থবিজ্ঞানী। কিন্তু একটার পর একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে–তখন কেন এই লোকগুলো চলে যাচ্ছে।
হিলারী হাঁ করে চেয়ে রইল।
টমাস বেটারটন দুমাস আগে প্যারিস থেকে উধাও হন।
হিলারী একটু নড়ে চড়ে বসলো। জেসপ বলে চললেন–মিসেস বেটারটন আমাকে এসে বললেন, তার পারিবারিক ডাক্তার তাকে বাইরে গিয়ে কিছুদিনের জন্য বিশ্রাম নিতে বলেছেন।
-হ্যাঁ, এটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না আমার, শুকনো গলায় বললো হিলারী।
–হ্যাঁ, এই অবস্থা থেকে কিছুদিনের জন্য তিনি মুক্তি চান।
–আমারও তাই মনে হয়।
মিসেস বেটারটনের পেছনে ফেউ লাগাবার ব্যবস্থা করলাম আমরা। গতকাল তিনি ক্যাসাব্লাঙ্কার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড ত্যাগ করলেন।