হো হো করে হেসে উঠলেন বেটারটন।
–সবকিছুই আপনারা ঠিকঠাক বলেছেন, শুধু একটু ভুল করে আমাকে টমাস বেটারটন ভেবেছেন। আমি বেটারটন নই।
তৃতীয় লোকটি পিটার্স এবার ভেতরে এসে বেটারটনের মুখোমুখি দাঁড়ালো। আপনিই বেটারটন–টমাস বেটারটুন আপনিই।
বেটারটন আবার হেসে বললো, আমার মনে হচ্ছে, গত একমাস একসঙ্গে থেকে, আমাকে টমাস বেটারটন নামে ডাকতে শুনে, আপনি হয়তো বিশ্বাস করেছেন যে আমিই টমাস বেটারটন। আসলে কিন্তু আমি টমাস বেটারটন নই। বিশ্বাস না হয় ওই ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করুন। উনি আমার কাছে এসেছিলেন, আমার স্ত্রীর ছদ্মবেশে। আমি ওঁকে আমার স্ত্রী বলে মেনেও নিয়েছিলাম। তাই না? আপনি কি বলেন?
হিলারী ধীরে ধীরে মাথা নাড়লো। তার কারণ, বেটারটন বলে চললো, যেহেতু আমি টমাস বেটারটন নই, স্বভাবতই টমাস বেটারটনের স্ত্রীকেও আমার চেনার কথা নয়।
বেটারটন হাসলো, আত্মবিশ্বাসের হাসি। আমি বেটারটন নই। বেটারটনের যে-কোনো ছবির সঙ্গে আমার চেহারা মিলিয়ে দেখুন, দেখবেন সত্যি কথাই বলছি আমি।
পিটার্স এগিয়ে এসে বললো, বেটারটনের ছবি আমি দেখেছি। স্বীকার করছি, টমাস বেটারটন হিসেবে আপনাকে আমি চিনতে পারিনি। কিন্তু আপনিই যে টমাস বেটারটন তাতে কোনো সন্দেহ নেই এবং তা আমি প্রমাণ করবো।
হঠাৎ সে শক্ত মুঠোয় বেটারটনের হাতটা চেপে ধরে, তার জামাটা ফড়ফড় করে ছিঁড়ে ফেললো। আপনি যদি টমাস বেটারটন হন, তাহলে আপনার ডান হাতের কনুইয়ের ওপর ইংরেজী জেড় অক্ষরের মতো একটা কাটা দাগ হবে। বলতে বলতেই সে বেটারটনের ডান হাতটা সবার সামনে মেলে ধরলো।
দাগটা দেখিয়ে বললো পিটার্স, এইখানেই আপনি আটকে গেলেন, মিঃ বেটারটন। যুক্তরাষ্ট্রে আপনার গবেষণাগারের দুজন সহকারী এই দাগ সনাক্ত করবে। এই দাগটার কথা আমি জানি, কারণ আপনার হাতে যখন এই ক্ষতটা হয় এলসা আমাকে চিঠিতে জানিয়েছিলো।
এলসা? বেটারটনের চোখদুটো কৃত্রিম পাথরের চোখের মতো স্থির হয়ে গেলো, এলসা? এলসার কথা কী বলছিলেন?
পুলিশ অফিসার এগিয়ে এসে বললেন, আপনার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ–ঠান্ডা মাথায় খুনের। আপনার স্ত্রী, এলসা বেটারটনকে হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে আপনার বিরুদ্ধে।
.
২২.
–আমি দুঃখিত, অলিভ, তোমাকে সাবধান করে দিয়ে সেদিন বলেছিলাম, ও থাক। অ্যারিস্টাইডসের ওখানেই ও নিরাপদে থাকতে পারবে। ওকে ধরার জন্য আমি দুনিয়া চষে বেড়িয়েছি। এলসাকে ও যা করেছে, তার ক্ষমা নেই আমার কাছে।
আমি বুঝতে পারছি না, আপনি কে?
ভেবেছিলাম, তা তুমি জানো। আমি–বোরিস আন্দ্রেই পাভলভ-গ্লাইদর। এলসার পিসতুতো ভাই। আমি আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করে অ্যান্ড্রু পিটার্স হয়ে গেলাম। তারপর এলো মহাযুদ্ধ। ইউরোপে ফিরে গিয়ে আমি প্রতিরক্ষার কাজে যোগ দিলাম। এলসার কথা তোমাকে আগেও বলেছি। সেই সময়ে সে একজন প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞানী। আসলে এলসাই শূন্যশক্তি বিভাজনের আবিষ্কত্রী। বেটারটন একজন কানাডিয়ান যুবক, নিজের গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সেই সময়ে সে ম্যানহেইমারের অধীনে কাজ করতে আসে। সে ভেবেচিন্তে এলসার সঙ্গে ভাব জমিয়ে তাকে বিয়ে করলো, যাতে এলসার সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতে পারে। এলসার গবেষণা যখন শেষ হওয়ার মুখে, বেটারটন উপলব্ধি করলো–এই শুন্যশক্তি বিভাজন, কী যুগান্তকারী আবিষ্কার হতে চলেছে। সে এলসাকে বিষ খাওয়ালো।
-ওঃ। না, না।
-হ্যাঁ, তখন কারো কোনো সন্দেহ হয়নি। কাজের মধ্যে ডুবে রইলো সে। নতুন উদ্দীপনায় কাজ করে কিছুদিনের মধ্যে সে শূন্যশক্তি বিভাজনকে তার নিজের আবিষ্কার বলে ঘোষণা করলো। সে যা চেয়েছিলো তাই হলো। খ্যাতি, যশ এবং প্রথমশ্রেণীর বিজ্ঞানী হিসাবে স্বীকৃতি পেলো।
যুদ্ধ শেষ হবার পরেও বেশ কিছুদিন আমাকে ইউরোপে থাকতে হয়েছিলো। মৃত্যুর আগে লেখা এলসার একটা চিঠি পেয়ে আমি ভীষণ চঞ্চল হয়ে উঠলাম। যে রোগে সে ভুগছিলো এবং যাতে সে মারা গেল দুটোই আমার কাছে কেমন যেন রহস্যজনক বলে মনে হলো। শেষ পর্যন্ত যখন আমেরিকায় ফিরলাম, এ নিয়ে নানারকম অনুসন্ধান শুরু করলাম আমি। যা আমি খুঁজছিলাম, সেটা পেয়ে গেলাম। বেটারটন দেখলো, হত্যার অপরাধে ধরা পড়ার এবং শাস্তি এড়াবার চমৎকার পথ খোলা রয়েছে তাই অ্যারিস্টাইডসের শর্ত মেনে নিয়ে সে ওখানে চলে গেলো। তার নিজের একমাত্র দাবি ছিলো,–অস্ত্রোপচার করে তার মুখের চেহারা সম্পূর্ণ বদলে দিতে হবে। আসলে সে দেখলো, এক বন্দীশালা এড়িয়ে সে অন্য এক ভয়ঙ্কর বন্দীশালায় এসে পড়েছে। আরও বিপদ–সে দেখলো, সে এদের চাহিদা মতো নতুন কিছু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করতে পারছে না–এ এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। নতুন আবিষ্কার করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না–কারণ সে কোনোদিনই বৈজ্ঞানিক প্রতিভার অধিকারী ছিলো না।
-আর-আপনি ওকে অনুসরণ করলেন?
-হা কাগজের পাতায় পাতায় যখন কৃতী বিজ্ঞানী টমাস বেটারটনের নিরুদ্দেশ নিয়ে তোলপাড় চলছে, আমি ইংল্যান্ডে এসে আবিষ্কার করলাম স্পীডার নামে এক ভদ্রমহিলা, বেটারটনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। মোটামুটি খোঁজখবর করে আমি ভদ্রমহিলার সাথে আলাপ জমালাম। ভান করলাম, যেন আমি অতি বড় বামপন্থী চিন্তাধারার সমর্থক। প্রথম থেকেই আমার ধারণা ছিলো বেটারটন নিশ্চয়ই কোনো কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে তাই কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গীর সমর্থক সেজেছিলাম। কারণ আমি জানতাম–আর কেউ না পারুক, সমস্ত ঝুঁকি নিয়েও আমাকে যে তার কাছে পৌঁছতেই হবে।.এলসা একজন প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞানী ছিলো, কী সুন্দর শান্ত নম্র মেয়ে। সেই শান্ত মেয়েটা যাকে ভালোবেসেছিলো, যাকে বিশ্বাস করেছিলো–সেই তাকে খুন করলো, তার সর্বস্ব অপহরণ করে তাকে নিঃস্ব করে দিলো। যদি প্রয়োজন হয়, নিজের হাতে বেটারটনকে খুন করতেও একটুকু হাত কাঁপবে না আমার।