অনেকক্ষণ ধরে অভ্যর্থনাপর্ব চললো। দু-পক্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় শেষ হতে মন্ত্রীমহাশয় জিজ্ঞেস করলেন, অ্যারিস্টাইডসকে দেখছি না। সে আমাকে কথা দিয়েছিল এখানে আমার সঙ্গে দেখা করবে।
অ্যারিস্টাইডস গতকালই স্পেন থেকে এসেছেন, উনি আপনাদের জন্য ভেতরে অপেক্ষা করছেন।
ছোট্ট দলটা এগিয়ে চললো। মন্ত্রীমহাশয় যেন ঈষৎ উদ্বিগ্ন। ভয়ে ভয়ে ডানদিকের মোটা লোহার বেড়ার দিকে তাকালেন। ফাঁক দিয়ে সামান্য দেখা গেলো, কুষ্ঠরোগীরা যেন সব সারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।
চমৎকার সাজানো গোছানো অতি আধুনিক লাউঞ্জে অতিথিদের অপেক্ষায় বসেছিলেন মিঃ অ্যারিস্টাইডস।
একজন সাংবাদিক অ্যারিস্টাইডসকে বললো, বাঃ! একটা চমৎকার জায়গা তৈরি করেছেন, স্যার।
অমায়িক হাসি হেসে অ্যারিস্টাইডস বললেন, হ্যাঁ, এ জায়গা আমার গর্ব।
অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য চমৎকার ভোজর আয়োজন করেছিলেন অ্যারিস্টাইডস। নানারকমের পানীয় এলো। তুর্কী কফির পর পরিদর্শনের কাজ শুরু হলো।
ঘণ্টাদুয়েক ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু তারা দেখলেন। পরিদর্শনের কাজ শেষ হতে মন্ত্রীমহাশয় খুব খুশী। মন্ত্রীমহাশয় মুগ্ধ হলেও অন্যদের অনুসন্ধিৎসা কিন্তু বাধ মানছিলো না। এখানকার ডাক্তার গবেষকরা কীরকম জীবন কাটান, রোগীদের কী ভাবে রাখা হয় ইত্যাদি নানারকম খুঁটিনাটি প্রশ্নে তারা ডাঃ ভ্যান হিদেমকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন।
লেবল্যাঙ্ক আর জেসপ, যথাক্রমে মন্ত্রীমহাশয় ও ব্রিটিশ বাণিজ্যদূতের সঙ্গে হাঁটছিলো। দুজনেই ইচ্ছে করে খানিক পিছিয়ে পড়লো। অন্যান্য লাউঞ্জে গিয়ে বসলো। লেবল্যাঙ্ক ফিসফিস করে বললোকই কোনোরকম সূত্র তো পাওয়া যাচ্ছে না–একটুও কিছু পাচ্ছি না–
-না, কোনো সঙ্কেতই পাচ্ছি না।
–তা যদি হয়, মানে আমরা যদি ভুল পথে এসে থাকি তাহলে যে কী হবে ভাবতে পারছি না।
-এখনও বিশ্বাস হারাচ্ছি না আমি, জেসপ বললেন। আমাদের বন্ধুরা এখানেই আছে। এ বিষয়ে আমি স্থির নিশ্চিত।
–কিন্তু তাদের তো কোনো পাত্তাই নেই।
–তা অবশ্য ঠিক। হয়তো নিজের সন্ধান জানাবার কোনো সুযোগই তারা পায়নি।
–তাহলে আমরা প্রমাণ পাবো কী করে?
–অস্থির হয়ো না, লেবল্যাঙ্ক। আমি বলছি, এখনি হতাশ হবার মতো কোনো কারণ ঘটেনি।
–আপনি খুব আশাবাদী…হতাশ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালো লেবল্যাঙ্ক।
–গাইবার কাউন্টারের নাম শুনেছো, লেবল্যাঙ্ক?
–নিশ্চয়ই শুনেছি। কিন্তু আমি বিজ্ঞানী নই, বুঝতেই পারছেন।
–আমিও নই। তবে এটুকু জানি যে গাইগার কাউন্টার, তেজস্ক্রিয় ধরার অতি শক্তিশালী যন্ত্র। সুতরাং
–সুতরাং?
–আমাদের বন্ধুরা এখানেই আছে, আমার গাইগার কাউন্টার তাই বলছে। আমাদের বন্ধুরা এখানে খুব কাছাকাছি রয়েছে। এই অট্টালিকা অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে গোলকধাঁধার মতো করে সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানে কোনো একটা অংশ নিশ্চয়ই আমার দেখতে পাচ্ছি না। সেটা আমাদের দেখানোও হয়নি।
–শুধু তেজস্ক্রিয়তার সূত্র ধরেই কি আপনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছচ্ছেন?
–ঠিক তাই।
আমার প্রধান ভরসাস্থল ঐ সাংবাদিকরা। খবর সংগ্রহ করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে ওদের। গোপন কিছু গন্ধ পেলেই ওদের কান খাড়া হয়ে ওঠে। সাধারণ লোকে যা একেবারে হেসে উড়িয়ে দেয় সে খবরও বিশ্বাস করে ওরা। আর বিশ্বাস আছে আমার–ওই বৃদ্ধ মানুষটির ওপর।
সবশেষে মন্ত্রীমহাশয় চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে একটু যেন শঙ্কিত স্বরে বললেন, তাহলে–আমার মনে হয়, এখন আমাদের যাবার সময় হয়েছে। যা যা দেখার ছিলো সবই আমাদের দেখা হয়ে গেছে…শেষ কথাগুলো একটু যেন তাৎপর্যপূর্ণ। ঝোঁক টেনে বললেন, এবার আমরা বিদায় নিতে পারি। আপনারা কি বলেন?
কথাগুলো একদিক থেকে একেবারে সাধারণ ভদ্রতা দেখানোর মতো। আসলে কিন্তু সমস্ত কথাগুলোই ইঙ্গিতপূর্ণ। মন্ত্রীমহাশয় তাঁর সঙ্গীদের ঘুরিয়ে একথাই বোঝালেন, আপনারা তো সবই দেখলেন, কিছুই নেই। আপনারা যা সন্দেহ করেছিলেন, যে আশঙ্কা ছিলো আপনাদের, তার বিন্দুমাত্র চিহ্নও এখানে নেই। এবার আমরা মনে শান্তি নিয়ে ফিরতে পারি।
ঠিক সেই মুহূর্তে গম্ভীর স্বরে জেসপ মন্ত্রীকে বললেন, আপনার অনুমতি নিয়ে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই, স্যার।
-ও-নিশ্চয়ই। হ্যাঁ মিঃ জেসপ, প্রশ্ন করুন।
জেসপ সোজা ডাঃ ভ্যান হিদেমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অ্যারিস্টাইডসকে এড়িয়ে গিয়ে বললেন, এখানে আপনাদের অনেক লোকজন দেখলাম। সত্যিই অবাক হতে হয়। কিন্তু আমার এক পুরানো বন্ধু এখানে আছে, তার সঙ্গে কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। যাবার আগে তার সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করতে আপনাদের কোনো অসুবিধে হবে না আশা করি?
-আপনার বন্ধু? ভীষণ চমকানিটা সামলে নিলেন ডাঃ ভ্যান হিদেম।
–হ্যাঁ–ঠিক বলতে গেলে–দুজন বন্ধু। একজন মহিলা, মিসেস বেটারটন, অলিভ বেটারটন। যতদূর জানি, তার স্বামী এখানে গবেষণা কাজে লিপ্ত। আগে হারওয়েল থাকতেন, তার আগেও আমেরিকায় ছিলেন। যাবার আগে ওঁদের সঙ্গে একটু দেখা করতে পারলে খুশি হতাম।
ভ্যান হিদেমের চোখেমুখে চিন্তার ছায়া পড়লো। কপালে বিস্মরণের ভাজ ফেলে বললেন, বেটারটন-মিসেস বেটারটন। না এ নামে এখানে কেউ নেই বলেই আমার বিশ্বাস।