ইংরেজীতে লেখা। C.O.GL.E.PR.O.S.I.E.S.L. শেষ দুটো অক্ষর পেনসিলের দাগ দিয়ে আলাদা করে দিলো লেবল্যাঙ্ক। বললো–SL–এটা আমাদের সঙ্কেত লিলি–যার অর্থ, প্রাপ্তি স্বীকার করতে হবে না।
আর COG হচ্ছে–যা দিয়ে সঙ্কেতবার্তা শুরু হচ্ছে তার আদ্যাক্ষর এবং আমাদেরই লোকের পাঠানো সঙ্কেতের প্রমাণ, তাই তো? বললে জেসপ।
হা। তাহলে বাকিটুকুই হচ্ছে আসল সংবাদ, বাকি অক্ষরগুলোর তলায় মোটা করে দাগ টানলো লেবল্যাঙ্ক। বললো, বাকি রইলো LEPROSIE, অনিশ্চিত শব্দটা বার বার দেখতে লাগলো সে।
-Leprosy? মানে কুষ্ঠ? জেসপের মুখে কথাটা যেন আপনা থেকেই জুগিয়ে গেলো।
তোমাদের এখানে কুষ্ঠরোগীদের কোনো নামজার্দা বা সাধারণ আশ্রম-টাম আছে নাকি?
লেবল্যাঙ্ক একটা বিরাট মানচিত্র এনে টেবিলের ওপর বিছিয়ে দিলো। আঙুল দিয়ে একটা স্থান নির্দেশ করলো। এই যে, এই জায়গাটুকুর ওপর আমাদের এই প্লেনের পর্যবেক্ষণের ভার ছিলো। দাঁড়ান, খুঁজে দেখি মনে হচ্ছে পাবো।
দ্রুতপায়ে ঘর থেকে বেরিলয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে বললো, পেয়েছি। এই জায়গাটায় এক বিখ্যাত ভেষজ গবেষণাকেন্দ্র আছে। একজন সুপরিচিত জনহিতৈষী এর প্রতিষ্ঠাতা এবং কর্ণধার। জায়গাটা মরুভূমির মাঝখানে–একেবারে নির্জন। কিন্তু যতদূর জানি এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আমাদের প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি স্বয়ং এর পৃষ্ঠপোষক।
-হুঁ। দারুণ চমৎকার কাজ স্বীকার করতেই হবে। জেসপের চোখে মুখে প্রশংসা ফুটলো।
কিন্তু যে-কোনো সময় পরিদর্শন করার জন্য এ জায়গা উন্মুক্ত। এই বিষয়ে উৎসাহী ডাক্তার গবেষকরা প্রায়ই পরিদর্শনে যান ওখানে।
এবং তাদের যা দেখার নয়, তা দেখতে পান না। কেনই বা পাবেন বলো? সর্বোচ্চ সম্মানের আড়ালে কোনো খারাপ কাজ করা যত সহজ, এত সহজ আবহাওয়া আর কিছুতেই সৃষ্টি করা যায় না।
তা অবশ্য ঠিক,-লেবল্যাঙ্ক বললো, হতে পারে যাত্রাপথে কেউ কেউ হয়তো ওখানে থামে। মধ্য ইউরোপের দু-একজন ডাক্তার নাকি একবার অমনি নেমেছিলে শুনেছি। এরকম ছোট্ট ছোট্ট দল, যেমন একটি দলের সন্ধান পেয়েছি আমরা–তারা হয়তো তাদের গন্তব্যস্থলে যাবার পথে কটা দিন ওখানে কাটিয়ে যায়।
তারচেয়েও অনেক বেশি কিছু বলে আমার মনে হচ্ছে। আমার মনে হয়–সম্ভবত এখানেই যাত্রা শেষ হয়।
কুষ্ঠরোগীদের আশ্রম–কথাটা বেশ ইঙ্গিতবহ মনে হচ্ছে।…আমার বিশ্বাস, আধুনিক, চিকিৎসায় কুষ্ঠরোগ আজকাল বাড়িতেও সারানো সম্ভব।
-সভ্যদেশে হয়তো সম্ভব। কিন্তু এ দেশে সেকথা কেউ চিন্তাও করতে পারে না।
-ঠিক তা নয়। কুষ্ঠরোগ–কথাটার মধ্যেই যেন মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা লুকিয়ে রয়েছে, যখন কুষ্ঠরোগীদের গলায় ঘন্টা ঝুলিয়ে পথচারীদের পথ ছেড়ে দেবার জন্য সাবধান করে দেওয়া হতো। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক কে? সেই জনহিতৈষী দানশীল মহাপুরুষের নামটা জানতে পারি?
সহজেই জানা যাবে। একটু দাঁড়ান। কয়েক মিনিটের মধ্যে পাশের ঘর থেকে একটা নথি নিয়ে এলো।-বেসরকারী একটি সংস্থা এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা। জনহিতৈষী কিছু লোক– যাঁদের মধ্যে প্রধান হচ্ছেন মিঃ অ্যারিস্টাইডস। নিশ্চয় জানেন–এই ভদ্রলোকের অগাধ টাকা। প্যারিস এবং সেভিলিতে বিরাট বিরাট হাসপাতাল তৈরি করে দিয়েছেন উনি। এই প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনা এবং কাজকর্ম সবকিছুই তার, অন্যান্য দাতারা নামেমাত্র তার সহযোগী।
–আচ্ছা তাহলে এটা একটা অ্যারিস্টাইডসের সংস্থা! আর এই অ্যারিস্টাইডস অলিভ বেটারটন যখন ফেজ-এ ছিলো তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
-অ্যারিস্টাইডস! লেবল্যাঙ্ক পাথর হয়ে গেলো। কিন্তু এও কি সম্ভব?
–সম্ভব!
–এ–সম্পূর্ণ অবাস্তব?
বাস্তবিকই!
–যাই বলুন–এ কিন্তু ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক কাজ।
–বটেই তো।
–কিন্তু কাজটা যে কতখানি বিপজ্জনক তা কি বুঝতে পারছেন? লেবল্যাঙ্ক উত্তেজনায় ছটফট করে উঠলো। এই অ্যারিস্টাইডস, বলতে গেলে দেশের সবকিছুর ওপরেই এঁর প্রভাব রয়েছে। ব্যাঙ্ক, কলকারখানা, অস্ত্রশস্ত্র, পরিবহন, সরকার সবকিছুর পেছনেই এঁর অদৃশ্য হাত। কেউ তাঁকে কোনোদিন চোখে দেখেনি, বড়জোর হয়তো ওঁর নাম শুনেছে। প্রচুর প্রতিপত্তি তার।
এই সমস্ত নিরুদ্দেশ সংক্রান্ত ব্যাপারে অ্যারিস্টাইডসের হাত থাকতে দেখলে মোটেই আশ্চর্য হবে না, বরং বলবো–একথা আগেই আমাদের চিন্তা করা উচিত ছিলো। এটা একটা চমৎকার ব্যবসায়িক চাল। রাজনীতির সঙ্গে বিন্দুমাত্র সংস্রব নেই এর। কিন্তু আসল প্রশ্ন হচ্ছে–এ ব্যাপারে আমরা কী করছি?
লেবল্যাঙ্কের মুখে যেন অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। না না, এ কাজ মোটেই সহজ নয় বুঝতেই পারছেন, আমাদের ধারণা যদি ভুল হয় তাহলে কী যে হবে বুঝতেই পারছেন। আর যদি সত্যি হয়, তাহলে এটা যে সত্যি তা আমাদের প্রমাণ করতে হবে। এমনকি আমরা যদি অনুসন্ধান শুরুও করি, তাহলেও যে-কোনো মুহূর্তে ওপরওয়ালাদের সর্বোচ্চ স্তর থেকে অনুসন্ধান বন্ধ করার নির্দেশ আসতে পারে–বুঝতে পারছেন? কিন্তু এ কাজ সহজ না হলেও আমাদের করতেই হবে।
.
২০.
পাহাড়ী পথেও ঝড় উড়িয়ে গাড়িগুলো পাহাড়ের গায়ে বসানো বিশাল ফটকটার সামনে এসে থামলো। চারটে গাড়ির প্রথমটায় রয়েছেন ফরাসি মন্ত্রীসভার একজন সদস্য আর আমেরিকান রাষ্ট্রদূত। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় গাড়িতেও নামকরা লোক আছেন। চতুর্থটির যাত্রীরা সাধারণ লোকের কাছে তেমন সুপরিচিত নন, কিন্তু নিজ নিজ পদমর্যাদায় এঁরা যথেষ্ট নামী লোক। এঁদের মধ্যে রয়েছে ক্যাপ্টেন লেবল্যাঙ্ক এবং মিঃ জেসপ। ধোপদুরন্ত সোফাররা গাড়ির দরজা খুলে বিশিষ্ট অতিথিদের সম্মান দেখাবার জন্য নুয়ে পড়লো। বিশাল ফটকটা যেন হুট করে খুলে গেলো। পরিচালক স্বয়ং অভ্যর্থনায় এগিয়ে এলেন, সঙ্গে সহপরিচালক, দুজন নামকরা ডাক্তার এবং রসায়নশাস্ত্রের গবেষক একজন।