হ্যাঁ সত্যিই আপনি বুদ্ধিমতী, মাদাম। ফেজ-এ আপনাকে প্রথম দেখেই আমি বুঝে নিয়েছিলাম। আপনি হয়তো জানেন না, মাদাম, আমি ফেজ-এ গিয়েছিলাম স্রেফ আপনাকে দেখার জন্য।
-আচ্ছা! বিস্ময় প্রকাশ করলো হিলারী।
এখানকার অনেক কিছুই আস্তে আস্তে আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন মাদাম। তবে একটা বিষয়ে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, যদিও এখানকার লোকেরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন আদর্শ নিয়ে এসে মোহমুক্ত এবং বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে, কিন্তু আমি বলছি, শেষ পর্যন্ত এরা সব্বাই একটা মাত্র আদর্শ মেনে নিতে বাধ্য হবে।
হিলারী বললো, নিশ্চিতভাবে সে কথা আপনি বলতে পারেন না আপনি।
–এ দুনিয়ার কোনো বিষয়েই কেউ সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারে না। এদিক থেকে আমি আপনার সঙ্গে একমত।
কেমন যেন আতঙ্কিত চোখে তাকালো হিলারী। কী সাংঘাতিক! ঠিক যেন টাইপিস্টদের একটা দল-মুখের কথা খসামাত্রই মেসিন থেকে কিছু উগরে বের করে দেবে। টাইপিস্টদের বদলে আপনি এখানে কিছু মস্তিষ্কের সমাবেশ ঘটিয়েছেন শুধু।
–ঠিক তাই। ভারি সুন্দর ভাবে জিনিষটা বুঝিয়েছেন মাদাম।
আর এই দল থেকে আপনি এক-একজন বিজ্ঞানীকে বিক্রি করবেন যে সবচেয়ে বেশি দাম দেবে তার কাছে?
-হ্যাঁ, মোটামুটি এটাই হচ্ছে আমার সাধারণ নীতি, মাদাম। লোবোটমি কথাটা কখনও শুনেছেন, মাদাম? কপালে ভাঁজ পড়লো হিলারীর।
মস্তিষ্কে একধরনের অস্ত্রোপচার, তাই তো?
–ঠিক বলেছেন, আসলে উন্মাদ রোগের চিকিৎসার জন্য এই অস্ত্রোপচার প্রচলিত। আপনাকে আমি সহজ ভাষায় বলছি, এই অস্ত্রোপচারকে আমরা নতুন কাজে লাগিয়েছি। এই অস্ত্রোপচারের পর সেই রোগীর আর আত্মহত্যা করার কোনো স্পৃহা থাকবে না, অপরাধবোধ হারিয়ে যায়, সে তখন অবচেতন মন নিয়ে উদাসভাবে ঘুরে বেড়ায়, কাজ করে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা অত্যন্ত প্রভুভক্ত হয়ে পড়ে।
-এ পরীক্ষায় আপনি সফল হয়েছেন কি?
–অতীতে হইনি। কিন্তু এখন এ বিষয়ে গবেষণায় আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি। আমার এখানে এখন তিনজন নামকরা শল্যচিকিৎসক রয়েছেন, একজন রাশিয়ার, একজন ফ্রান্সের আর একজন অস্ট্রিয়ার। মস্তিষ্কের বিভিন্নরকম পরীক্ষা চালিয়ে তারা এই সিদ্ধান্তেই এসেছেন যে, মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তিকে এতটুকুও খর্ব না করেই এই অস্ত্রোপচারের সাহায্যে তাকে সম্পূর্ণ বশীভূত করা সম্ভব।
–কিন্তু কী ভয়ঙ্কর-ওঃ! চিৎকার করে উঠলো হিলারী।
-না, প্রয়োজন। অবিচল স্বরে শুধরে দিলেন অ্যারিস্টাইডস। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা মানুষেরই উপকারের জন্যই।
–এরকম যে কোনোদিন হবে, আমি বিশ্বাস করি না।
-শুনুন মাদাম, আমি যদি বলি এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করার যোগ্য নন আপনি, আমায় মাফ করবেন।
-আমি বলতে চেয়েছিলাম–কর্মসচেষ্ট, বিশ্বস্ত একটা জানোয়ার যে সত্যিকারের কোনো বুদ্ধির কাজ দেখিয়ে কোনো কিছু সৃষ্টি করতে পারে, এ আমি বিশ্বাস করি না।
–আপনি বুদ্ধিমতী, হয়তো ঠিকই বলেছেন। সময়েই সেটা দেখা যাবে। গবেষণা পরীক্ষা নিরীক্ষা তো চলছে, দেখা যাক।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা! মানে? মানুষ নিয়ে পরীক্ষা?
–তা তো বটেই, মাদাম। সত্যিকারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার একমাত্র মাধ্যমই তো মানবদেহ।
–কিন্তু কী ধরনের মানবদেহ সেগুলো?
অযোগ্য লোকদের নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। যারা এখানকার জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। তারা আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার চমৎকার মাধ্যমে পরিণত হয়।
আঁতকে উঠলো হিলারী। সামনে বসা বৃদ্ধটিকে কেমন যেন বীভৎস অমানুষ বলে মনে হলো অথচ ওর কথাগুলো মিথ্যে নয়, অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ। হিলারী বললো, আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না? আপনি বাইবেল পড়েন তো?
নিশ্চয়ই, রোজ পড়ি মাদাম।
–মোজেস আর অ্যারন, ফারাওকে কী বলেছিলেন মনে আছে? বলেছিলেন, আমার লোকজনদের যেতে দাও।
অদ্ভুত হাসলেন অ্যারিস্টাইডস। তাহলে আমি হচ্ছি ফারাও?–আর আপনি একই দেহে মোজেস এবং অ্যারন? আপনি আমাকে এটাই বোঝাতে চাইছেন তাই তো, মাদাম? এই লোকগুলোকে যেতে দিতে বলছেন–সব্বাইকে নাকি শুধু–বিশেষ কাউকে!
-আমি তো বলবো সব্বাইকে।
–কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, এতে শুধুই সময় নষ্ট হবে। তার চেয়ে বরং…আপনার স্বামীর জন্য ওকালতি করলে ভালো হতো না?
–সে এখন আপনার কাছে অপ্রয়োজনীয় এতদিনে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন?
-আপনার কথাই হয়তো ঠিক, মাদাম। হ্যাঁ, টমাস বেটারটন সম্পর্কে দারুণ হতাশ হয়েছি আমি। আমি ভেবেছিলাম আপনি আসার পর সে আবার প্রতিভার উন্মেষ ঘটাতে পারবে। কিন্তু আপনি আসার পরও ওর কাজে কোনো উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। স্রেফ শুধু সাধারণ কাজ করছে।
হিলারী বললো, এক-এক জাতের পাখি, যারা খাঁচাবন্দী অবস্থায় তেমন মিষ্টি সুরে গান গাইতে পারে না। হয়তো বিজ্ঞানীদের মধ্যেও তেমন জাত আছে, যারা বিশেষ বিশেষ অবস্থা সৃষ্টির চিন্তায় মনোনিবেশ করতে পারে না।
–তা হতে পারে। আমি অস্বীকার করছি না।
–তাহলে আপনি বেটারটনকে বাইরের জগতে ফিরে যেতে দিন।
–তা সম্ভব নয়, মাদাম। বাইরের দুনিয়ার কাছে এই জায়গায় খবর পৌঁছে দেবার মতো প্রস্তুতি এখনও গড়ে তুলতে পারিনি আমি।
–ও কাউকে কিছু বলবে না, এই শপথ করিয়ে নিতে পারেন।