মিঃ অ্যারিস্টাইডসকে চিনতে পারার সঙ্গে সঙ্গে, গত দশদিনের অবাস্তব স্বপ্নময় জগতের ছবিটা ভেঙে খান খান হয়ে গেলো। সত্যিই এটা একটা অবাস্তব সংস্থা। বাইরে থেকে যা বলে এটাকে প্রচার করা হয় আসলে এটা মোটেই তা নয়। মহামান্য পরিচালকের ওই মোহময় কণ্ঠস্বর, ওটাও অবাস্তব–আসল সত্য লুকিয়ে রয়েছে এখানে–এই ছোট্ট প্রাচ্য অনুভূতি মাখা ঘরটায়। এই বিশাল কর্মকাণ্ডের মধ্যমণি হিসেবে মিঃ অ্যারিস্টাইডসকে দেখে সবকিছুরই পরিষ্কার অর্থ খুঁজে পাওয়া গেলো–নিষ্ঠুর অথচ বাস্তব দৈনন্দিন জীবনের ছবিটা স্পষ্ট ফুটে উঠলো হিলারীর চোখে।
-এতক্ষণে বুঝলাম, এ সবকিছুই আপনার তাই না?–হিলারী বললো।
–ঠিকই বুঝেছেন, মাদাম।
–আর পরিচালক? আপনার ওই পরিচালক?
মিঃ অ্যারিস্টাইডস প্রশংসা করে বললো, খু-উ-ব ভালো লোক, অগাধ টাকা মাইনা দিই। ওঁকে। পুনরভ্যুত্থান সংক্রান্ত সভার বক্তৃতা দেওয়াই ওঁর প্রধান কাজ।
চিন্তিতভাবে কমুহূর্ত নীরবে ধূমপান করার পর তিনি হিলারীকে বললেন, ওখানে আপনার পাশে তুরস্কের বিখ্যাত পানীয় আছে। কিছু মিষ্টিও আছে। ইচ্ছে করলে নিতে পারেন। আবার কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন, আমি একজন জনহিতৈষী সামান্য মানুষ, মাদাম। আর আপনি তো জানেন আমি বিরাট ধনী। আমার এই অগাধ অর্থ নিয়ে, জনগণের সেবা করার একটা কর্তব্যজ্ঞান বার বার আমাকে পীড়িত করে। তাই এই মরুপ্রান্তরে কুষ্ঠরোগীদের সেবার জন্য আমি একটা আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছি। দুনিয়ার সবচেয়ে নামীদামী ডাক্তার, বিজ্ঞানীরা কুষ্ঠরোগ নিরাময়ের জন্য মূল্যবান গবেষণা চালাচ্ছেন এখানে। দেখা গেছে কয়েক ধরনের কুষ্ঠরোগই সারানো সম্ভব বাকিগুলো সম্ভব নয়, কিন্তু আমরা হাল ছাড়িনি। লোকে যেমন কুষ্ঠরোগকে ছোঁয়াচে মনে করে সেরকম ছোঁয়াচে নয়। বসন্ত, টাইফয়েড, প্লেগ বা ওই ধরনের রোগগুলো যেমন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, কুষ্ঠরোগ তত দ্রুত ছড়ায় না। তবুও আপনি যদি কাউকে বলেন, ওটা কুষ্ঠরোগীদের আশ্রম, সে সভয়ে অনেক দূরে চলে যাবে। কুষ্ঠরোগীদের প্রতি ভীতি সেই বাইবেলের কাহিনী থেকে শুরু হয়েছে। এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে আমি নিজেকে শান্তি দিয়েছি।
–শুধু এইজন্যই আপনি এ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন?
-হ্যাঁ। এখানে ক্যানসার নিয়ে গবেষণারও আলাদা বিভাগ রয়েছে আর যক্ষ্মারোগ নিয়ে উন্নতমানের কাজ সমাপ্তপ্রায়। জীবাণু নিয়ে গবেষণা চলছে। আমার এই বিস্ময়কর কাজ দেখে সারা দুনিয়া অবাক হয়ে গেছে। পৃথিবীখ্যাত ডাক্তার, শল্যচিকিৎসক, আর রসায়নবিদেরা মাঝেমাঝেই এখানে এসে আমাদের কাজ দেখে বিস্মিত হন। তেমনি একটা দল আজ এসেছে। এখানকার বাড়িগুলো অত্যন্ত নিপুণভাবে তৈরি, যার ফলে এর একটা বিশেষ অংশ বাইরের জগতের সামনে সম্পূর্ণ বন্ধ, এমনকি আকাশ থেকেও তা দেখা যায় না। অতি গোপনীয় গবেষণাগারগুলো পাহাড়ের নিচে সুড়ঙ্গ কেটে তৈরি। কোনো দিক দিয়েই কেউ এতটুকুও সন্দেহ করতে পারবে না কারণ–আমি কী বিরাট ধনী তা তো আপনি জানেনই।
-কিন্তু কেন? হিলারী বললো, কেন এই ধ্বংস যজ্ঞের আয়োজন?
–ধ্বংসের প্রতি আমার কোনো স্পৃহা নেই, মাদাম। আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন।
মিঃ অ্যারিস্টাইডস বলে চললেন, আমি একজন ব্যবসায়ী, সেই সঙ্গে আমি একজন সংগ্রাহকও। অর্থ যখন মানুষের কাছে পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে তখন তার থেকে মুক্তি পাবার একটামাত্র উপায়। সারাজীবনই অজস্র জিনিষ সংগ্রহ করেছি আমি। যেমন ধরুন–ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর এবং দামী ছবি, বিশেষ ধরনের মৃৎশিল্প এবং ডাকটিকিট সংগ্রহ। বিশেষ কয়েকটা জিনিষের নমুনা সংগ্রহ যখন সম্পূর্ণ তখন অন্য কিছু সংগ্রহের দিকে ঝোঁক পড়েই। আমি বৃদ্ধ মানুষ, তাছাড়া সংগ্রহ করার মতো কিছু বাকি নেই দেখে শেষ পর্যন্ত মানুষের মস্তিষ্ক সংগ্রহ করতে লেগে গেলাম।
হিলারী আঁতকে উঠে বললো, মস্তিষ্ক?
আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন তিনি, হ্যাঁ, মস্তিষ্ক মানুষের বুদ্ধি। সমস্ত বুদ্ধিমান মাথাগুলোকে এখানে এনে জড়ো করেছি। বুদ্ধিমান কাঁচামাথা, শুধু এরাই আমার সংগ্রহ।
বুঝতে পারছেন এটাই আমার পেশা হিলারীকে বললো, আমি টাকার ব্যাপারী।
–আপনি বলছেন–এসবের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই? বিশ্বশক্তিকে নিজের হাতের মুঠোয় আনতে চান না?
ভর্ৎসনায় ভরে উঠলো তার মুখ। ঈশ্বরের আসনে বসার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই।
–কিন্তু এতসব নামী নামী লোকদের আপনি এখানে আনলেন কী করে?
–ওদের আমি কিনেছি। বেশির ভাগ সময়েই ওঁদের আমি কিনি আদর্শের বিনিময়ে। কখনো কখনো আমি তাদেরও কিনি যারা আইনের চোখে অপরাধী–তাদের কিনি নিরাপত্তার বিনিময়ে।
হিলারী বললো, এতক্ষণে সব বুঝতে পারলাম। এখানে আসার পথে যা যা দেখে আমি সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছিলাম, এতক্ষণে সেগুলো পরিষ্কার হলো।
-ও! আসার সময় তাহলে খুব আশ্চর্য হয়েছিলেন আপনি?
-হ্যাঁ। ছোট্ট প্লেনের পাঁচটি যাত্রী–প্রত্যেকের লক্ষ্য কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন। অ্যান্ড্রু পিটার্স, ওই–আমেরিকার যুবকটিকে দেখে মনে হয় সম্পূর্ণ বামমার্গী। কিন্তু এরিকসন, অতিমানবে শুধু বিশ্বাসী তাই নয়–একেবারে বদ্ধ পাগল। হেলগা নীডহেইম তো উদ্ধত, নিকৃষ্ট ধর্মের চণ্ডনীতির একনিষ্ঠ পূজারী। ডাক্তার ব্যারন, উনি স্রেফ টাকার জন্যই এসেছেন।