–নাঃ, এতে কাজ হবে না মনে হচ্ছে, হতাশ সুরে গলা নামিয়ে বললো পিটার্স। কী জানি কেন–এই মুহূর্তে এটা কাজ করছে না। কিন্তু এক সময় হয়তো কাজে লাগবে–শেষ বারান্দার প্রান্তে একটা দরজা দেখা গেল। দরজাটা আপনা থেকে খুলে যেতে দেখে, সবাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়লো।
পিটার্স পকেট থেকে সিগারেট বের করার সাথে সাথেই ভ্যান হিদেম স্পষ্ট স্বর ভেসে এলোধূমপান করবেন না দয়া করে। একথা আগে থেকেই আপনাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
–দুঃখিত স্যার। পিটার্স বললো।
–একটু পরেই সবাইকে এগোতে বলা হলো।
হিলারী বললো, ঠিক যেন ভেড়ার পাল যাচ্ছে।
মেয়েদের থাকার জায়গায় আলাদা–ডানদিকে, মিস জেনসেন মেয়েদের নিয়ে ডানদিকে বেঁকে গেলো। ছেলেরা বাঁ-দিকে।
লম্বা শয়নঘরটা অনেকটা হাসপাতালের রোগীদের ঘরের মতো–দেওয়ালের দুধারে সার সার করে খাট পাতা-শালীনতা রক্ষার জন্য প্লাস্টিকের পর্দা টেনে আড়াল করার ব্যবস্থা তাতে। বিছানার পাশেই ছোট্ট একটা দেরাজ। হাসপাতালের মতোই কিসের গন্ধে ম ম করছে ঘরটা।
মিস জেনসেন বললো, এখানকার ব্যবস্থাপত্র একেবারেই ছিমছাম। ওই ডানদিকে স্নানঘর, আর ওপাশের ওই দরজার ওধারের ঘরে সকলের গল্পগুজব, খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে।
গল্প করার ঘরে মেয়ে পুরুষ আবার একসাথে মিলিত হলো।
দিনের বেলাটা ভালোই কাটলো। ছোট্ট পর্দায় দুটো ছবি দেখানো হলো। ঘরে আলোর ব্যবস্থা চমৎকার। ঘরে যে জানালা নেই এটা ঢাকা দেবার জন্যই যেন দিনের আলো ফোঁটাবার সার্থক প্রয়াস। সন্ধ্যার দিকে নতুন আলোর ব্যবস্থা।
-বাঃ! চমৎকার বুদ্ধি তো! পিটার্স বললো। যাতে কেউ চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী রয়েছে না ভাবতে পারে তার চমৎকার ব্যবস্থা।
হিলারী ভাবছিলো নিজেরা কত অসহায়। এখানে কোথাও তাদের খুব কাছেই, বাইরের দুনিয়া থেকে একটি দল এসে রয়েছে। অথচ তাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করার কোনো উপায় নেই।
পিটার্স মিস জেনসেনের সঙ্গে গল্প করছে বসে। হিলারী মার্চিসনদের কাছে ব্রিজ খেলার প্রস্তাব করলো। টম বেটারটনকে রাজি করানো গেল না। তার কিছুতেই মন বসছে না। ডাঃ ব্যারন ওদের সঙ্গে তাসে বসলেন।
আশ্চর্য! খেলতে খেলতে একসময় হিলারীর মনে হলো, খেলতে তো খারাপ লাগছে না। বেশ জমেছিলো খেলাটা, হিলারী হাতঘড়িটা দেখলো একবার। ও বাবা–অনেক রাত হয়ে গেছে দেখছি! তা আমাদের মহামান্য অতিথিরা এতক্ষণে নিশ্চয়ই চলে গেছেন–নাকি রাত্রে এখানে থাকবেন?
সাইমন বললো, ঠিক বলতে পারব না।
বিয়াঙ্কা বললো, যাই বলো ব্যবস্থাপত্র কিন্তু দারুণ ভালো। হিলারীকে সঙ্গে নিয়ে সে মেয়েদের ঘরে যাবার জন্য এগোল।
হিলারী তাকে এগিয়ে যেতে দিয়ে ইচ্ছে করেই একটু পিছিয়ে পড়লো। আর তখনই হাতে একটা মৃদু স্পর্শ অনুভব করলো। চট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলো, দীর্ঘকায় একজন সুরেশ ভৃত্য তার পাশে দাঁড়িয়ে। কালো গায়ের রঙ। ভৃত্যটি বললো, মাফ করবেন, মাদাম, আপনাকে আমার সঙ্গে আসতে হবে।
-আসতে হবে? কোথায় আসতে হবে?
দয়া করে আমার সঙ্গে আসুন—
মুহূর্তের সংশয় নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো হিলারী। বিয়াঙ্কা ঘরে চলে গেছে। এ ঘরে মার্চিসন আর ডাঃ ব্যারন কী যেন আলোচনায় মগ্ন। হাতের ওপর আবার সেই জরুরী তাগিদের স্পর্শ। আসুন মাদাম।
হিলারী একটু ইতস্তত করে পা বাড়ালো।
অন্যান্য ভৃত্যদের তুলনায় এই ভৃত্যটির পোষাক-আশাক যে অনেক অভিজাত সেটা হিলারী দেখলো।
বসার ঘরের এককোণের একটা ছোট্ট দরজা দিয়ে সে তাকে নিয়ে চললো। তারপর আবার সেই গোলকধাঁধা বারান্দা। যে পথ দিয়ে তারা এখানে এসেছিলো, এটা সে পথ বলে মনে হলো না। সমস্ত পথগুলোই এমন নিখুঁত পরিকল্পনায় তৈরি যে, সবগুলোই একই রকম মনে হয়।
শেষ পর্যন্ত একটা বারান্দার শেষে এসে, দেওয়ালের গাছে একটা বোতাম টিপলো লোকটা। দেওয়ালের খানিকটা অংশ একপাশে সরে গেলো। পেছনে একটা ছোট্ট লিস্ট। হিলারীকে উঠতে ইঙ্গিত করে সে নিজেও উঠলো।
এবার সরাসরি প্রশ্ন করলো হিলারী। কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমায়?
লোকটি বললো, কর্তার কাছে, মাদাম, এটা আপনার পক্ষে দারুণ সম্মানের বিষয়।
-কর্তা–মানে? পরিচালকের কথা বলছো?
–না-কর্তার কাছে..
লিফট থামলো। একপাশে সরে দরজা খুলে সে হিলারীকে নামতে বললো। তারপর আবার বারান্দা পেরিয়ে একটা দরজা-ভৃত্যটি আস্তে আস্তে টোকা দিতে দরজাটা খুলে গেলো। এখানে আরেকজন ভৃত্য দাঁড়িয়ে আছে।
নতুন লোকটি হিলারীকে একটা ছোট্ট লাগোয়া ঘরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চললো। ঘরের মেঝেতে লাল কার্পেট, ওধারের দেওয়ালের ভারী পর্দা একদিকে সরানো। সেই নিচু নিচু সোফা, কফির টেবিল, নকশা কাটা সুন্দর পর্দা। আর একটা নিচু ডিভানে বসে একটা আবছা মূর্তি নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারলো না হিলারী। চামড়া কোঁচকানো, হলুদ রঙের ছোট্ট এক বৃদ্ধ–। অবিশ্বাসভরে স্থির চোখে বৃদ্ধ মিঃ অ্যারিস্টাইডসকে দেখতে লাগলো হিলারী।
.
১৮.
আসুন মাদাম, মিঃ অ্যারিস্টাইডস অভ্যর্থনা জানালেন। তার হাতের ইঙ্গিতে হিলারী একটা ডিভানে বসলো।
মিঃ অ্যারিস্টাইডসের গলায় অদ্ভুত চাপা অট্টহাসি ফুটলো। খুব অবাক হয়েছেন, তাই না? একেবারে অপ্রত্যাশিত, কি বলেন?
হিলারী বললো, তা বটে, আমি কল্পনাও করতে পারিনি যে, আপনি