আচমকা বক্তৃতা শেষ করলেন পরিচালক। সাহস এবং জয়। শুভরাত্রি! হলঘর থেকে বেরিলয়ে এলো হিলারী–কেমন যেন স্বপ্নাচ্ছন্ন মূক। আশপাশের সব মুখগুলোই এই অনুভূতির ছাপ দেখলো।
হঠাৎ কনুইয়ের কাছে তার স্পর্শ অনুভব করলো হিলারী। অ্যান্ড্রু পিটার্স! কানের কাছে মুখ এনে বললো, চলুন ছাদে যাই। একটু হাওয়ার দরকার এখন।
লিফটে উঠে কেউ কোনো কথা বললো না। ছাদে এসে, তারাভরা আকাশের নিচে পামগাছের জটলার মধ্যে হারিয়ে গেলো দুজনে। পিটার্স গভীর শ্বাস টেনে বললো, আ! এইটাই দরকার ছিলো। এমন হাওয়া যা অহঙ্কারের ঘন মেঘকে দূরে তাড়িয়ে নিয়ে যায়।
হিলারী উত্তরে শুধু দীর্ঘ করে একটা শ্বাস ফেললো। এখনও যেন ঠিক প্রকৃতিস্থ হতে পারছে না সে।
পিটার্স আলতো করে ওর হাতখানা তুলে নিলো। এসব ভুলে যাও অলিভ। এসব ভুলে যাও। তুমি নারী সম্পূর্ণ নারী হয়ে যাও। বাস্তবে ফিরে এসে রূঢ় বাস্তবকে দেখো। এই অহঙ্কারের বিষ বাষ্পের রেশ যখন কেটে যাবে, তখন বুঝতে পারবে–সেই আগের মতো, সেই পুরোনো কথাগুলিই তুমি শুনছিলে।
–কিন্তু সত্যিই সুন্দর মানে, চমৎকার আদর্শ এটা।
–আদর্শের নামে এ পাগলামি। ঘটনাগুলো সাজাও। যুবশক্তি এবং মস্তিষ্ক–চমৎকার! একেবারে স্তোত্রপাঠ। আর এই যুবশক্তি আর মস্তিষ্কের ধারক কারা? এতক্ষণ যে বক্তৃতা শুনে এলে তার মোদ্দা কথা হচ্ছে-সাংঘাতিক ক্ষতিকর পাগলামি।
আলসের ওপর বসে পড়ে হিলারী বললো, আপনি হয়তো বুঝবেন আপনার কথাই ঠিক বলে আমি বিশ্বাস করি…কিন্তু অহঙ্কারের সেই ঘন মেঘ যে এখনও থমকে রয়েছে। এই মেঘ উনি কিভাবে সৃষ্টি করতে পারলেন? উনি কি নিজেই এসব বিশ্বাস করেন?
উদাস স্বরে পিটার্স বললো, শেষ পর্যন্ত কিন্তু সব জিনিষেরই একই পরিণতি হয়। আর প্রত্যেক পাগলই নিজেকে ঈশ্বর বলে ভাবে।
হঠাৎ হিলারীর কি মনে হলো, বললো, কাজটা বোধহয় ঠিক করিনি। বেটারটন কী ভাববে? নিশ্চয়ই বিসদৃশ লাগবে ওর চোখে।
-না না, আমার তা মনে হয় না। ও হয়তো খেয়ালই করেনি।
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে পিটার্স বললো, আমি দুঃখিত অলিভ। এ জায়গাকে তোমার নিশ্চয়ই সাজানো নরক বলে মনে হচ্ছে। তোমার স্বামী ধীরে ধীরে সেই নরকের পাঁকে ডুবে যাচ্ছে।
এখান থেকে আমাদের পালাতেই হবে–পালাতেই হবে।
আমরা পালাতে পারবো।
একথা তো আগেই বলেছো পিটার্স–কিন্তু এতটুকুও এগোতে পারিনি আমরা–ওর হাতটা আঁকড়ে ধরলো হিলারী।
পেরেছি বইকি। আমি চুপ করে বসে নেই। বিস্ময়ে স্তব্ধ মুক দৃষ্টি তুলে তাকালো হিলারী।
কোনো পরিকল্পনা ঠিক করিনি, কিন্তু তলে তলে আমি একে ধ্বংস করার কাজ শুরু করে দিয়েছি। প্রচণ্ড অসন্তোষ ধুমায়িত হয়ে রয়েছে এখানে–সে অসন্তোষ, সে বিদ্বেষ আমাদের ‘প্রভু পরিচালক কল্পনা করতেও পারবেন না। এ অসন্তোষ এখানকার নিচুতলার মধ্যেই সবচেয়ে ব্যাপক। খাদ্য, অর্থ, বিলাসিতা এবং নারীই জীবনের সবকিছু নয়। আমি তোমাকে এখান থেকে উদ্ধার করবোই, অলিভ।
–আর টম?
পিটার্সের মুখখানা থমথমে হয়ে উঠলো। শোনো অলিভ, আমার কথা বিশ্বাস করো, টম এখানে থাকার জন্যই আপ্রাণ চেষ্টা করবে। হ্যাঁ সে…বাইরের জগতের চেয়ে এখানেই অনেক বেশি নিরাপদ মনে করবে।
নিরাপদ? কী বলছো তুমি পিটার্স? হিলারী বললো, তুমি ঠিক কি বলতে চাইছো আমি বুঝতে পারছি না, টম–নিশ্চয়ই এ কথা বোঝাতে চাইছে না যে, সে সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেছে।
মোটেই না। হয়তো সে খুবই অস্থির হয়ে পড়েছে, কিন্তু আমি বলবো বেটারটন ঠিক তোমার আমার মতোই সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ।
–তাহলে সে নিরাপদে এখানে থাকবে, একথা বলছো কেন?
খুব ধীরে ধীরে পিটার্স বললো, খাঁচার মতো নিরাপদ জায়গা আর নেই, একথা স্বীকার করবে?
-না, প্রায় চিৎকার করে উঠলো হিলারী। তুমিও যে একথা বিশ্বাস করো তা বোলো না আমায়। নিরাপদ, পোষমানা, সুখী জীবন? না, আমরা বিদ্রোহ করবোই। মুক্তি আমাদের চাই-ই।
-জানি, কিন্তু…তুমি জানো না টম এখান থেকে মুক্তি পাবার জন্য ছটফট করছে।
–টম হয়তো জানে না তার পক্ষে কোন্টা ভালো কোন্টা মন্দ।
হঠাৎ টমের কথায় হিলারীর মনে পড়ে গেলো। তাই তো, সে যদি কোনো গোপন তথ্য ফাস করে দিয়ে থাকে, তাহলে তো তাকে সরকারী গোপনীয়তা রক্ষা আইনানুসারে শাস্তি পেতে হবে! হিলারী আবার বললো, টমও যাবে আমাদের সঙ্গে।
পিটার্সের গলায় তিক্ততার আভাস পেয়ে ভীষণ চমকে গেলো হিলারী। নিজের কথা আগে ভাবো। আমি বার বার তোমায় বলেছি, অলিভ। ওই লোকটা কে–কেন তুমি ওর জন্য এত ভেবে মরছো আমি বুঝতে পারছি না।
আতঙ্কে স্থির চোখ মেলে চেয়ে রইলো হিলারী। অনেক অনেক কথা সে বলতে চেয়েছিলো। অনেক কষ্টে সে নিজেকে সংযত করলো।
বিছানায় শুয়ে টম সিগারেট টেনে হিলারীকে বললো, আমেরিকান বন্ধুটির সঙ্গে খুব ভাব জমেছে দেখছি!
হিলারীর গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো। বললো–আমরা একসঙ্গে এখানে এসেছি। তাছাড়া কিছু কিছু বিষয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনাও এক।
টম বলে উঠল, না না, তোমাকে আমি দোষ দিচ্ছি না। সত্যিই তোমাকে খুব সুন্দর দেখতে অলিভ।
সেই প্রথম দিন থেকে হিলারী টমকে বার বার অনুরোধ করেছে তাকে তার স্ত্রীর নাম ধরে ডাকতে। এতদিনে আজ ডাকলো।
হিলারীকে ভালো করে দেখে টম বললো, সত্যিই তুমি অসম্ভব সুন্দরী। একটিবার অত্যন্ত এটা আমার চোখে পড়া উচিত ছিলো। কিন্তু এখন সবকিছুর মতো এও আমার মনে রেখাপাত করে না।