-সেটা সম্পূর্ণই আলাদা ব্যাপার।
–মূল কথাটা কিন্তু আলাদা নয়। যেখানে ঢোকার রাস্তা আছে, বেরুনোর রাস্তাও নিশ্চয়ই আছে সেখানে। যদি মনের জোর নিয়ে এগোনো যায়, তাহলে ছদ্মবেশ ধরে, অভিনয় করে, ঘুষ দিয়ে বা যে-কোনো শঠতার আশ্রয় নিয়ে এগোলে এ কাজ অসম্ভব নাও হতে পারে। তবে অনেক ভাবতে হবে–বুদ্ধি বের করতে হবে। এখন আমি জোর গলায় বলছি–এখান থেকে আমি পালাবোই, সে যেভাবেই হোক।
–আপনি তা পারবেন বলেই বিশ্বাস করি, কিন্তু আমি কি পারবো?
–তা-আপনার ক্ষেত্রে অবশ্য এটা আলাদা।
পিটার্সের গলাটা যেন কেমন ধরা ধরা ঠেকছিলো হিলারীর কানে। ওর কথাটা উপলব্ধি করতে মুহূর্তের জন্য মনটা থমকে দাঁড়ালো। মনে পড়লো–সে যে তার ইঙ্গিত বস্তু লাভ করেছে এটাই তো লোকের ভাবা স্বাভাবিক। এখানে সে এসেছে প্রিয়তমের সঙ্গে মিলিত হতে। এখানে একা পালানোর প্রয়োজনীয়তা নিশ্চয় থাকতে পারে না।
এই মুহূর্তে পিটার্সকে সত্যি কথাটা বলে দেবার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করে উঠলো হিলারী–কিন্তু কোন্ এক শক্তি যেন তাকে থামিয়ে দিলো।
শুভরাত্রি জানিয়ে তাড়াতাড়ি সে ছাদ থেকে নেমে এসেছিলো।
১৬. রোগা পাতলা মেয়েটি
১৬.
–শুভ সন্ধ্যা, মিসেস বেটারটন।
-শুভসন্ধ্যা মিস জেনসেন।
চশমা পরা রোগা পাতলা মেয়েটিকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছিলো। মোটা কাঁচের পেছনে চোখ দুটো চকচকে করছে। বললো, আজ রাত্রে একটা পুনর্মিলন উৎসব হবে। পরিচালক স্বয়ং আমাদের সামনে ভাষণ দেবেন।
-বাঃ ঢমকার, কাছেই পিটার্স দাঁড়িয়ে ছিলো, সে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। পরিচালককে একবার চোখে দেখার জন্য আমি দিন গুনছিলাম।
মিস জেনসেন কড়া চোখে তাকিয়ে বললো, আমাদের পরিচালক, অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি।
-এখানে থাকার সবচেয়ে মুশকিল হচ্ছে, কোথায় যে যাচ্ছেন তা কখনোই সঠিক জানতে পারবেন না। আমিও আমেরিকা ছাড়ার আগে যদি জানতে পারতাম যে এসব আদর্শ টাদর্শ ধোঁকা, আসলে কোনো স্বৈরাচারীর খপ্পরে গিয়ে পড়ছি, তাহলে
–আসলে যে এরা তা নয়, সেটাও কিন্তু এখনও জানতে পারেননি, হিলারী স্মরণ করিয়ে দিলো।
–হুঁ, এখানের বাতাসে যেন সেই রকম গন্ধই পাচ্ছি।
–সত্যি! হিলারী প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো। আপনি এখানে আছেন বলে কী ভালোই না লাগছে।
মিস জেনসেনের ঘোষণা মতো নৈশভোজের পর সেই পুনর্মিলন উৎসবের আসর বসলো, সংস্থার প্রতিটি সদস্য এসে বিশাল বক্তৃতা ঘরে জড়ো হয়েছে।
শ্রোতাদের মধ্যে সবরকমের পেশার লোক রয়েছে এখানে। কারিগরী শিক্ষার লোকজন ছাড়াও সেখানে রয়েছে ব্যালে নাচের একটি দল, সামরিক তকমা আঁটা কিছু হোমরাচোমরা। এছাড়া একপাশে রয়েছে সুন্দরী মেয়েদের দল। এরা এই সংস্থার যে-সমস্ত পুরুষের স্ত্রী নেই বা যারা এখানকার নারী কর্মীদের সঙ্গে কোনোরকম বিশেষ সম্পর্ক পাতায়নি তাদের দৈহিক সাহচর্য দান করে সংস্থার সেবা করে।
বেটারটনের পাশে বসে হিলারী দারুণ উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিলো, কখন সেই প্রায় অলৌকিক চরিত্রটি পরিচালক, বক্তৃতা মঞ্চে পা দেবেন। টমকে জিজ্ঞেস করায় কিছু ভাসা ভাসা উত্তর পেয়েছে সে।
টম বলেছিলো, দেখার মতো কোনো বৈশিষ্ট্য তার নেই, কিন্তু তার উপস্থিতির একটা তীব্র প্রভাব আছে। আসলে আমিও তাকে দুবারের বেশি দেখিনি। প্রত্যেকে অনুভব করে কী দারুণ প্রভাব ওঁর-সত্যিই তাই, অথচ কেন, তা আমি আজও বুঝতে পারিনি।
শ্রদ্ধায় গদগদ মিস জেনসেন ও আর কটি মহিলা পরিচালক সম্পর্কে আলোচনা করছিলো। হিলারী মনে মনে পরিচালকের একটি ছবি ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করলোসোনালি শ্মশ্রুগুম্ফমণ্ডিত আনন, শ্বেতশুভ্র উত্তরীয়-আবৃত দীর্ঘ ঋজু দেহ–অনেকটা দেবতার মতো আবছা একটা ছবি।
শ্রোতৃবৃন্দ নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াতে হঠাৎ সে চমকে দাঁড়ালো। হিলারী দেখলো, একজন মধ্যবয়সী মোটাসোটা লোক ধীর পায়ে মঞ্চে উঠে এলো।
তিনটি ভাষায় তিনি বক্তৃতা করলেন। প্রথমে ফরাসি, তারপর জার্মান তারপর ইংরেজি তিনটি ভাষায় সমান সাবলীলতায় অনর্গল কথা বলছিলেন।
নবাগত সহকর্মীদের কিছু প্রশস্তি জানিয়ে তিনি এই সংস্থার উদ্দেশ্য এবং চিন্তাধারা সম্পর্কে দীর্ঘ বক্তৃতা করলেন।
পরে তাঁর কথাগুলো মনে করতে চেষ্টা করে বিফল হয়েছে হিলারী।
নিরাসক্তির প্রবল বাধাসত্ত্বেও কথাগুলো যেন তীব্র উন্মাদনায় হিলারীর মনের অর্গল মুক্ত করে তাকে নাড়া দিতে লাগলো, তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চললো। পরিচালক অত্যন্ত সহজভাবে ব্যাখ্যা করছিলেন। তাঁর বক্তৃতার প্রায় সবখানি জুড়ে যৌবনের গুণগান। যৌবনের পরেই মানবজাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
পুঞ্জীভূত অর্থ, প্রতিপত্তি, ক্ষমতাবান মুষ্টিমেয় পরিবার–এ সমস্ত পুরোনো দিনের নির্ধারক শক্তি। কিন্তু আজ, যুবসমাজই সেই শক্তির ধারক। মানুষের বুদ্ধিই হচ্ছে আসল শক্তি। সে বুদ্ধি রসায়নশাস্ত্রে, পদার্থবিদ্যায়, শারীরবিদ্যায়…গবেষণাগার থেকেই ব্যাপক ধ্বংসকার্যের শক্তি স্ফুরিত হয়। আমাদের এই সংস্থা, সারা দুনিয়ার সেই শক্তিমানদের সমন্বয় ক্ষেত্র। এখানে আপনারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে জড়ো হয়েছেন, সঙ্গে এনেছেন সৃজনী বিজ্ঞানের নানান তথ্য জ্ঞান, আর এনেছেন–আপনাদের যুবশক্তি। এমন একদিন আসবে, যখন আমরা আমাদের একটা অছি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারবো। বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিমত্তার জিম্মাদার হবে এই অছি-সংস্থা। পুঁজিপতি আর রাজাদের ওপর আমরা হুকুম করবো–সৈন্যবাহিনী আর শিল্পসংস্থা চলবে আমাদের নির্দেশে।