–অনেকটাই তাই। তবে ঠিক তার জন্য আমি আতঙ্কিত নই।
–তার জন্য নয়? তবে কিসের জন্য?
-না মানে–এই পরিবেশের সঙ্গে পাছে আমি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাই, ভয় আমার সেই জন্য।
মাঝে মাঝে আমার মনে হচ্ছে এখানে কোনোরকম ভোজবাজি চলছে না তো?
–ভোজবাজি? ভোজবাজি বলতে কী বোঝাতে চাইছেন?
-স্রেফ ভোজবাজি মানে ধোকা। সহজ ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, কোনোরকম আফিম টাফিম খাওয়াচ্ছে না তো?
-মানে–ওই ধরনের কোনো ওষুধ-টষুধ বলতে চাইছেন?
হ্যাঁ, ওই ধরুন, খাবার বা মদের সঙ্গে এমন কিছু মিশিয়ে দেওয়া হলো–যার ফলে আপনি কুঁদ হয়ে রইলেন যে আপনাকে দিয়ে যা খুশি করিয়ে নেওয়া চলে–মানে একেবারে বশ করা যাকে বলে।
-কিন্তু এমন কোনো ওষুধ আছে কি?
-না–মানে এমন ওষুধ আছে যাতে রোগীরা আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে, অস্ত্রোপচারের আগে তাদের অচেতন করে দেয়। কিন্তু বহুকাল ধরে নেশায় বুঁদ করে রেখে কাউকে বশ করে রাখা এবং একই সঙ্গে সেই লোককে দিয়ে বড় বড় কাজ করানোর দক্ষতা অর্জন করানোর মতো কোনো ওষুধ বেরিলয়েছে কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু আমার বিশ্বাস, এখানে এরা যে কোনো উপায়েই থোক প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। সোজা ভাষায় বলতে গেলে বলবো, আমার ধারণা এখানকার প্রশাসক এবং উদ্যোক্তরা নিশ্চয়ই সম্মোহনী বিদ্যায় খুব পোক্ত। একথা স্বীকার করতেই হবে। যে লোক নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নিয়ে স্বেচ্ছায় কোনো কাজ করতে আসে তাকে দিয়ে অনেক কাজ করানো যায়।
–কিন্তু তা বলে তো এ অবস্থা আমরা মুখ বুজে মেনে নিতে পারি না, রাগে প্রায় কুঁসিয়ে উঠলো হিলারী। এক মুহূর্তের জন্যও আমরা যেন না ভাবি, এখানে যা চলছে তা ভালো।
পিটার্স জিজ্ঞেস করলো, আপনার স্বামী কী বলেন?
–টম? সে-মানে, তার কথা আমি ঠিক জানি না। জানা সহজও নয়। আমি–কথা শেষ না করে সে চুপ করে গিয়েছিলো।
এমন একজন দরদী শ্রোতাকেও সে তার অদ্ভুত জীবনের কাহিনী শোনাতে পারলো না। গত দশদিন ধরে সে সম্পূর্ণ এক অচেনা লোকের সঙ্গে বাস করছে। একই শয়নঘরে কত বিনিদ্র রাতে পাশের বিছানা থেকে একজন অপরিচিত পুরুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনেছে। দুজনেই এ অবস্থাটাকে অবশ্যম্ভাবী বলে মেনে নিয়েছে। নেবেই বা না কেন? সে তো একজন ছদ্মবেশী গুপ্তচর। যে-কোনো পরিবেশ, যে-কোনো ব্যবস্থাই তাকে মেনে নিতে হবে। সত্যি বলতে কি, টম বেটারটনকে সে এতটুকুও বুঝতে পারে না। শুধু এই সংস্থায় এসে কয়েক মাসে একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানীর তাজা মনের যে কী হাল হয়, ও যেন তার জ্বলন্ত উদাহরণ। যে কারণেই হোক, ও যেন তার অদৃষ্টকে অত্যন্ত সহজ শান্তভাবে মেনে নিয়েছে মনে হয়। কাজের আনন্দে ডুবে থাকা তো দূরের কথা, কাজে মন বসানোর অক্ষমতাই যেন ওকে আরো চিন্তিত করে তুলছে বলে মনে হয় হিলারীর। প্রথম দিন সন্ধ্যায় যা বলেছিলো, পরে আরও দু-একবার সেই কথাই বলেছে টম।
নাঃ! আর আমি ভাবতে পারছি না। মনে হচ্ছে–আমার মনের মধ্যেটা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
সত্যি বলেই বিশ্বাস করেছে হিলারী। টম বেটারটন একজন সত্যিকারের প্রতিভাধর। তার বিকাশের জন্য সবচেয়ে আগে দরকার–স্বাধীনতা। স্বাধীনতা হারিয়ে ওর মনের বিকাশ স্তব্ধ হয়ে গেছে। একমাত্র সত্যিকারের মুক্ত পরিবেশই ওর পক্ষে কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব।
হিলারী বুঝেছে টম মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। হিলারীকেও সে পরম উদাসীনতায় উপেক্ষা করে চলেছে। ওর কাছে হিলারী যেন রক্তমাংসের নারী নয়, বন্ধুও নয়। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় হিলারীর, নিজের স্ত্রীর মৃত্যুও ওকে নাড়া দিতে পেরেছে কিনা। একটি মাত্র চিন্তাই যেন ওকে দগ্ধ করে তুলেছে–তা বন্দী জীবনের চিন্তা। বার বার ও বলেছে, আমি জানি না, আমি জানি না। কোথায় যে এর শেষ কোনো ধারণাই নেই আমার। এখান থেকে কী করে আমি মুক্তি পাবো? কী করে? জানি না কিন্তু আমি মুক্তি পেতে চাই।
পিটার্সের কথাগুলো ছিল দৃপ্ত। মোহভঙ্গের ক্রোধে জ্বলে ওঠা গভীর প্রত্যয় ছিলো তাতে। যে জায়গায় সে এসে পড়েছে, তার পরিচালকদের বুদ্ধিমত্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু হিলারীর মনে হলো, হয়তো ছমাস এখানে থাকলে পিটার্স আর সেও টম বেটারটনের মতো দুর্বল হয়ে পড়বে।
পাশের এই দরদী মানুষটার কাছে মনের কথা সব উজাড় করে দিতে ইচ্ছে হলো হিলারীর। শুধু–যদি সে বলতে পারতো : টম বেটারটন আমার স্বামী নয়। ওর সম্পর্কে কিছুই জানি না আমি। জানি না এখানে আসার আগে ও কেমন লোক ছিল। কিছু জানি না আমি–সম্পূর্ণ অন্ধকারে রয়েছি। ওকে আমি সাহায্য করতে পারি না, কারণ ওকে কী বলবো কী করবো কিছুই যে জানি না।
একথা মনে হতেই সাবধান হয়ে উত্তর দিলো হিলারী। বললো, টমকে এখন আমার কেমন যেন অচেনা মানুষ বলে মনে হয়। ও আমাকে কিছু বলে না। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় এই খোঁয়াড়ে বন্দী থাকার চিন্তায় ও পাগল হতে বসেছে।
–খুবই স্বাভাবিক, পিটার্স বললো, হতেই পারে।
–কিন্তু আপনি বলুন–একটু আগে আপনি জোর গলায় এখান থেকে পালাবার কথা বলছিলেন। কেমন করে পালাবেন? সত্যিকারের কোনো সম্ভাবনা কি দেখতে পাচ্ছেন?
-সমস্ত ব্যাপারটা চিন্তা করে, পরিকল্পনা করে আমাদের পালাতে হবে। কত বন্দীই তো কত অসম্ভব জায়গা থেকে পালায়। জার্মানির বন্দীশালা থেকে পালানোর ঘটনা নিয়ে আমার এবং আপনার দেশে তো কত বই লেখা হয়েছে।