তা সত্যি। কিন্তু আমাদের সতর্কতাটুকু আমাদের বজায় রাখতে হবে। কোনোক্রমে আমাদের শত্রুরা যদি এটা বুঝতে পেরে যায়, তাহলে আমাদের জন্য তারা ভুল পথের নিশানা রেখে যাবে। চারদিকে তখন হয়তো দেখবো, অজস্র গাড়িতে ফতিমার হাতের ছাপ।
পরদিন সকালে লেবল্যাঙ্ক আরেকটা জিনিষ এনে হাজির করলো। চেবানো চুইংগামের ওপর তিনটি ঝুটো মুক্তো ত্রিকোণাকারে সাজানো।
–এর মানে হচ্ছে, দেখে জেসপ বললেন, এরপর থেকে ওরা প্লেনে রওয়ানা হয়েছে। তিনি লেবল্যাকের দিকে তাকালেন।
–আপনি এক্কেবারে ঠিক বলেছেন, লেবল্যাঙ্ক বললো, একটা পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটিতে এটা পাওয়া গেছে। একেবারে নির্জন, দুর্গম জায়গা সেটা–অনেকদূর এখান থেকে। একটা প্লেন যে খুব শীঘ্রই সেখানে নেমেছিলো এবং আবার উড়ে গিয়েছিলো তার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। এখানে এসে আবার থমকে দাঁড়াতে হচ্ছে–জানি না এরপর আবার কোথায় ওদের সন্ধান করার মতো সূত্র খুঁজে পাবো।
.
১৫.
এ অসম্ভব, নিজের মনেই ভাবছিলো হিলারী। দশ-দশটা দিন আমি এখানে রয়েছি, এ যেন ভাবাই যায় না। জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাটাও আমি কত সহজে মেনে নিয়েছি।
প্রথম এখানে এসে, ভয়ঙ্কর আতঙ্কে সে কাঠ হয়ে গিয়েছিলো, বন্দিত্ব আর হতাশার এক ভয়ঙ্কর অনুভূতি–সেই বন্দিত্ব আবার যখন নানারকম বিলাস উপকরণের প্রলেপে মুক্তির মুখোশ ধরে আসে, সে যেন আরও ভয়ঙ্কর। কিন্তু তবুও এখন, একটা সপ্তাহ কাটতেই, মনের অগোচরে কখন যেন সে এই জীবনটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছে! সত্যিই অদ্ভুত! স্বপ্নের ঘোরে বাস যেন।
এই ভয়াবহ পরিবেশকেও মেনে নিতে পেরেছে, তার একটা কারণ সম্ভবত–সে নারী। মেয়েরা প্রকৃতির বশ। তারা পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচার করে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছে সে, তার সঙ্গে যারা এখানে এসেছে তাদের হাবভাব দেখে। হেলগা নীডহেইমকে তো খাবার সময় ছাড়া দেখাই যায় না। চোখাচোখি হয়ে গেলে জার্মান মহিলাটি একটু সেঁতো হাসি হেসে তাকে এড়িয়ে যায়। যতদূর সে বুঝেছে, তাতে হেলগা নীডহেইমকে বেশ সুখী সন্তুষ্ট বলে মনে হয়েছে। তার কল্পনার সঙ্গে এই সংস্থার জীবনযাত্রা নিশ্চয়ই মিলে গেছে। নিজের এবং তার সহকর্মী বিজ্ঞানীদের মর্যাদার আসন যে সবার উপরে একথা প্রমাণ করাই যেন তার প্রধান কাজ। মানবজাতির মুক্তি, বিশ্বশান্তি বা বিশ্বভ্রাতৃত্ব সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই।
ডাঃ ব্যারন কিন্তু হেলগা নীডহেইমের চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান। মাঝেমধ্যে হিলারীর সঙ্গে তার কিছু কথাবার্তাও হয়েছে। বেশ লোক। নিজের কাজে ডুবে আছেন। কাজ করার যে সুযোগ-সুবিধা তাকে দেওয়া হয়েছে তাতে একেবারে মুগ্ধ।
একদিন তিনি বলেছিলেন, এটা–ঠিক যেমনটা আমি আশা করে এসেছিলাম তেমন নয়। খোলাখুলি বলছি আপনাকে–একদম নয়। আরও একটা কথা চুপিচুপি বলে রাখি, মিসেস বেটারটন-বন্দীদশা আমার মনে কোনো রেখাপাত করে না। আর এখানকার জীবন–আমি মনে করি বন্দীজীবন।
-মানে–আপনি বলতে চাইছেন, যে স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে এখানে এসেছিলেন তার কিছুই খুঁজে পাচ্ছেন না? হিলারী জিজ্ঞেস করেছিলো।
হেসেছিলেন ডাক্তার, ক্ষীণ, বেদনাঝরা হাসি। বলেছিলেন, না না, আপনি ভুল করছেন। আসলে মুক্তির স্বাদ নিতে আমি আসিনি এখানে। আমি আপনাকে বলেছি, আমি এখানে এসেছি স্রেফ টাকার জন্য।
হিলারী তাকে জিজ্ঞেস করলো, এখানে টাকা নিয়ে আপনি কী করবেন?
-না–আসলে, গবেষণাগারের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এরা কিনে দেয়, ডাঃ ব্যারন বলেছিলেন। আমি স্রেফ বিজ্ঞানের নবতম আবিষ্কারের আনন্দে ডুবে থাকতে চাই। এছাড়া–ফ্রান্স ছাড়ার আগে ওরা আমাকে প্রচুর টাকা দিয়েছিলো। অন্য একটা নামে ব্যাঙ্কে সেগুলো নিরাপদে বেড়ে চলেছে। যথাসময়ে যখন এসব শেষ হবে তখন যেমন খুশী সেগুলো খরচ করতে পারবো।
–যখন এসব শেষ হবে? অবাক চোখে তাকিয়ে হিলারী কথাটা আওড়ালো।
ডাঃ ব্যারন হাসলেন। একটু বুদ্ধি থাকলেই বোঝা যায়, কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। আমার বিশ্বাস, কোনো কমিউনিস্ট শক্তি এ জায়গাটাকে চালাচ্ছে না। স্রেফ একজন পাগল-বদ্ধ পাগল এটাকে চালাচ্ছে।
এরিকসন, সে এই সংস্থার আবহাওয়ায় বেশ মানিয়ে নিয়েছে। ডাঃ ব্যারনের মতো বাস্তববাদী নয় সে, আত্মচিন্তায় বিভোর।
আমেরিকান যুবক অ্যান্ড্রু পিটার্সকে কিন্তু হিলারীর ভালো মনে হয়। পিটার্স একদিন বলেছিলো, আমি যে ঠিক কোথায় যাচ্ছি তাই অমি জানি না। এই জায়গার সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির কোনো যোগসূত্র থাকতেই পারে না। মস্কোর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্কই নেই।
হিলারী বলেছিলো, এ জায়গার আসল মালিক কে তা জানার জন্য আপনি একটু বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না?
–তা হয়তো সত্যি, বলেছিলো পিটার্স। আশেপাশে আমাদের কথা শোনার মতো কেউ নেই যখন তখন বলেই ফেলি। আমি এখান থেকে পালাতে চাই, সত্যি পালাতে চাই।
–খুব সোজা কাজ হবে না সেটা, গলা নামিয়ে বলেছিলো হিলারী।
ছাদবাগানে হাঁটছিলো তখন ওরা। নৈশভোজ শেষ হয়ে গেছে। পিটার্স বললো, মোটেই সহজ হবে না, কিন্তু কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
হিলারী বললো, আপনার মুখ থেকে একথা শুনতেও ভালো লাগছে না।
সহানুভূতির চোখে তাকাল পিটার্স। আপনি কি ভেঙে পড়েছেন?