ভুরু কুঁচকে বেটারটন বললো, কিন্তু এ কথা নিশ্চয়ই
তাড়াতাড়ি তাকে থামিয়ে দিয়ে হিলারী বললো, শুনতে যতটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে আসলে তা নয়। আপনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন এই সমস্ত ধ্যানধারণার প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে। সবদেশের মধ্যে বৈজ্ঞানিক গোপনীয়তার আদান-প্রদান, একটা নতুন জগৎ-এসব সম্পর্কেই আমার অসীম উৎসাহ। আর তার উপর আমার এই চুল–ওরা যদি প্রায় একই বয়সের একটি লাল চুলওলা মেয়েকেই শুধু আপনার স্ত্রী বলে আশা করে থাকে তাহলে আমার ধারণা সার্থক।
-হ্যাঁ, বেটারটন হিলারীর মাথাটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো, আপনার চুলগুলো ঠিক অলিভের মতো।
-তারপর আপনার স্ত্রীও বার বার অনুরোধ করতে লাগলেন–আপনাকে যে খবরটা পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন তা নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন।
-ও হ্যাঁ, খবর। কী খবর বলুন তো?
-আমাকে বলতে বলেছিলেন, সাবধান থাকতে–খুব সাবধান থাকতে–খুব বিপদ আপনার সামনে কোনো একজনের সম্পর্কে সাবধান থাকতে–তার নাম বোরিস।
-বোরিস? মানে বোরিস গ্লাইদরের কথা বলছেন?
–হুঁ, তাকে আপনি চেনেন?
মাথা নাড়ল বেটারটন। কোনোদিন চোখে দেখিনি তবে নাম শুনেছি। সে আমার প্রথমা স্ত্রীর আত্মীয়। ভালোভাবেই চিনি তাকে।
-তাহলে সে কেন আপনার পক্ষে বিপজ্জনক হবে?
–কী বললেন? কেমন যেন আনমনা হয়ে গেলো বেটারটন।
হিলারীর কথাটা শুনে বেটারটন বাস্তবে ফিরে এসে বললো, তা আমি জানি না, কিন্তু একথা সত্যি যে সব দিক দিয়েই সে অতি সাংঘাতিক লোক।
–কোন্ দিক দিয়ে?
মানে–সে এমন এক ধরনের আদর্শবাদে বিশ্বাসী যদি মনে করে যে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষকে মেরে ফেললে হয়তো কোনো ভালো হবে, তাহলে হাসতে হাসতে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষকেই খুন করে ফেলতে পারে।
হ্যাঁ, এ ধরনের লোকদের আমি চিনি, হিলারীর মনে হলো, সত্যিই সে এদের চেনে–খুব ভালোভাবে চেনে। কিন্তু কেন মনে হলো?
–অলিভের সঙ্গে কি তার দেখা হয়েছিলো? অলিভকে সে বলেছিলো?
–তা তো আমি জানি না, শুধু–এইটুকুই তিনি আমাকে বলেছিলেন। বিপদের কথা–আর হ্যাঁ, বলেছিলেন একথা তিনি বিশ্বাস করেন না।
বিশ্বাস করে না। কোন কথা বিশ্বাস করে না?
—তাও তো আমি জানি না। একটু দ্বিধা করে সে আবার বললো, বুঝতেই পারছেন–তিনি তখন মৃত্যুর পথে…।
বেটারটনের মুখে তীব্র যন্ত্রণার ছাপ পড়লো। বুঝতে পেরেছি..আমি বুঝতে পেরেছি…সময়ে এসবই হয়ে যাবে। কিন্তু বোরিসের কথাটা নিয়ে কেমন যেন ধাঁধায় পড়ে গেছি। এখানে সে আমার পক্ষে কী করে বিপজ্জনক হতে পারে। সে নিশ্চয়ই লন্ডনে গিয়েছিলো, তার অলিভের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো।
-হ্যাঁ, সে লন্ডনে ছিলো।
তাহলে, স্রেফ এটা আমার বুদ্ধির অগম্য…। আর তাতে কীই বা এসে যায়? আমরা এখানে এমনিতেই বন্দী..
-আশ্চর্য আমারও ঠিক এইকথাই মনে হচ্ছে।
–আমরা এখান থেকে আর বেরোতে পারবো না, সজোরে সে আলসের ওপর একটা ঘুসি মারলো।
হিলারী বললো, একশোবার পিরবো। চকিত বিস্ময়ে সে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো হিলারীর দিকে। কী বলছেন আপনি?
কেন, একটা পথ বের করবো আমরা।
পাগলী মেয়ে, বেদনার হাসিতে ভরে উঠলো তার মুখ। এখানে এই জায়গায় কাদের বিরুদ্ধে আপনাকে দাঁড়াতে হবে, সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্রও ধারণা নেই আপনার।
-যুদ্ধের সময় তো কত লোক, কত অসম্ভব জায়গা থেকে পালিয়ে আসে, বললো হিলারী। তারা তো সুড়ঙ্গ কেটে, বা যা হয় কিছু একটা উপায় করে পালায়।
-কঠিন পাথরের মধ্যে দিয়ে কী করে সুড়ঙ্গ কাটবেন? তাছাড়া সুড়ঙ্গ করে যাবেনই বা কোথায়? চারিদিকে তো শুধু ধূ ধূ মরুভূমি।
–প্রত্যেক ক্ষেত্রেই একটা-না-একটা পথ থাকেই। হয়তো তার জন্য সময় লাগবে, অনেক পরিকল্পনা করতে হবে,
আবার বেটারটনের মুখখানা থমথমে হয়ে উঠলো। সময়…এই সময় যে আমি দিতে পারছি না।
-কেন?
-জানি না আপনি বুঝবেন কিনা…আমি সত্যিই বলেছি। এখানে–একটুও কাজ করতে পারছি না আমি, সত্যি!
-কী বলছেন আপনি?
কী করে বোঝাই আপনাকে? আমি কাজ করতে পারছি না, চিন্তা করতে পারছি না। আমার যা কাজ তাতে অত্যন্ত মনঃসংযোগ দরকার। আমার কাজের অনেকটাই–প্রায় সবটাই সৃষ্টির কাজ। এখানে আসা থেকে সারা দিনরাত ধরে বাজে কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে সময় কাটাই, যে কাজ অতি সাধারণ বিজ্ঞানীও করতে পারে। কিন্তু এরজন্য তো ওরা আমাকে নিয়ে আসেনি। ওরা চায় আসল সৃষ্টি-নতুন কিছু সৃষ্টি…আর আমি সেই সৃষ্টি করতে পারছি না।
বেটারটন বললো, আমি যদি কিছু সৃষ্টি করে ওদের হাতে তুলেই না দিতে পারি, তাহলে এত কাণ্ড, এমন এলাহী কাণ্ডকারখানায় ওদের দরকার কী? ওরা তো আমাকে রাস্তায় ফেলে দেবে।
-না না।
-হ্যাঁ–দেখেই। এখানে ওরা ভাবপ্রবণতায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে না। এই প্লাস্টিক সার্জারির ব্যাপারটা যা একটু বাঁচিয়েছে আমাকে। জানেন বোধহয়, একবারে এই অস্ত্রোপচার হয় না–একটু একটু করে করা হয়। আর স্বাভাবিকভাবেই যে লোকের ওপর দিনের পর দিন একটানা ছোটখাটো অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে, সে কোনো কাজে মনঃসংযোগ করতে পারে না।
–কিন্তু এই অস্ত্রোপচারের কী দরকার ছিলো? কী জন্য করা হলো এটা?
–এটা? ওই–স্রেফ সাবধানতার জন্য। মানে–আমার সাবধানতার জন্য। এটা করা হয়–যদি আপনি পুলিসের প্রার্থিত লোক হন তখনই।