এই এত জল কোথা থেকে আসে?
ওই পাহাড়ের তলায় গভীর প্রস্রবণ খোঁড়া হয়েছে।ওটা আমাদের এই সংস্থার প্রাণ।
ছাদবাগানের এখানে-ওখানে কিছু লোক ছড়িয়ে রয়েছে। ক্রমে ক্রমে তারা এদিক-ওদিক চলে গেলো। মার্চিসনরাও ব্যালে দেখতে যাবে বলে বিদায় নিলো। হিলারীর হাত ধরে বেটারটন তাকে আলসের ধারে একটা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে এলো।
মাথার ওপর অজস্র তারা জ্বলজ্বল করছে। মৃদু শীতল বাতাসে শরীর জুড়িয়ে গেলো। দুজনে এখন সম্পূর্ণ একা। দুজন দুজনের মুখোমুখি দাঁড়ালো। একটু যেন সন্ত্রস্ত নিচু গলায় টম বেটারটন জিজ্ঞেস করলো, এবার বলুন, কে আপনি?
হিলারী তার চোখে চোখ রেখে একটু নীরব হয়ে ওর প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করলো, আগে আপনি বলুন, কেন আমাকে আপনার স্ত্রী বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন?
দুজনেই দুজনের দিকে তাকাচ্ছে। হিলারী জানে ইংল্যান্ড থাকতে টম বেটারটনের যত শক্তিই থাক-না-কেন এখানে এই অবস্থায় তার মনের জোর হিলারীর চেয়ে অনেক দুর্বল।
অবশেষে টম বেটারটন হার মানলো। সে নিজের মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, তখন মানে সেই মুহূর্তে যেন আমার এটাই সঠিক মনে হয়েছিল। হয়তো ভীষণ বোকামি করেছি আমি, আমার যেন একবার আশা হয়েছিলো, আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাবার জন্য আপনাকে এখানে পাঠানো হয়েছে।
–তাহলে আপনি এখান থেকে বের হতে চান?
–হায় ভগবান, আপনি একথা জিজ্ঞেস করতে পারলেন?
–প্যারিস থেকে আপনি কিভাবে এখানে এলেন?
টম বেটারটন একটু হাসলো। আমাকে কেউ জোর করে এখানে আনেনি–অবশ্য জানি না, এই কথাই আপনি জানতে চাইছেন কিনা। আমি এসেছি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়।
–আপনি যে এখানেই আসছেন, সেটা আগে থেকেই জানতেন?
-না, আমি যে আফ্রিকায় আসছি সে সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিলো না আমার। অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিক প্রলোভনেই আমি ভুলেছিলাম। আপনার সঙ্গে এলো, ঐ যে পিটার্স, ও বেচারাও ঠিক আমার মতোই ভুল করেছে।
–আর এখানে এসে দেখলেন যা ভেবেছিলেন, তা নয়?
আবার একটু হাসল টম। নিজের চোখেই দেখবেন। ঠিক যেমনটি হওয়া উচিত ছিল তা যেন নয়। এ–একে স্বাধীনতা বলে না।
হিলারীর পাশে বসে সে বলল, ইংল্যান্ডে থাকতে যে জ্বালায় ছটফট করতাম, এখানেও তাই। সবসময় মনে হচ্ছে কেউ যেন আমার ওপর নজর রাখছে। এতরকমের সব নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্যই হয়তো একথা মনে হতো। একজনের চলাফেরা, কাজকর্ম, বন্ধুবান্ধব সম্পর্কে একরকম গুপ্তচরবৃত্তি হয়তো দরকারও আছে, কিন্তু আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি এতে মানুষ পাগল হয়ে উঠতে বাধ্য।
হিলারী স্পষ্ট সুরে বললো, আপনি বলতে চাইছেন–যে পারিপার্শ্বিকতা থেকে আপনি মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন, এখানে এসে আপনাকে ঠিক সেই অবস্থাতেই পড়তে হয়েছে? এখানেও সেই একইভাবে আপনার ওপর নজর রাখা হচ্ছে, গুপ্তচরবৃত্তি চলছে?
একটু বিব্রতবোধ করে বেটারটন বললো, এ বিষয়ে আমি ঠিক জানি না। আসলে আদৌ আমার ওপর নজর রাখা হচ্ছে কিনা তাও জানি না। কেনই বা আমার ওপর নজর রাখবে? কেনই বা এত মাথা ঘামাবে? এরা তো আমাকে এখানে এই জেলখানায় এনে রেখেছে?
–তার মানে–আপনি যা কল্পনা করেছিলেন, তার বিন্দুমাত্রও দেখতে পাননি?
-না, সেইটেই সবচেয়ে আশ্চর্য। একদিক থেকে দেখলে কিন্তু এটা ভালোই লাগবে। কাজ করার আদর্শ পরিবেশ রয়েছে এখানে। সবরকমের সুযোগ সুবিধে যন্ত্রপাতি। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও আপনি ভুলতে পারবেন না যে আপনি বন্দী।
-জানি আমি। আমরা ভেতরে ঢোকার পর যখন বাইরের ফটকটা শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেলোতখনই কেমন যেন ভয়ে গা শিরশির করে উঠেছিলো। হিলারী একটু কেঁপে উঠলো।
–বেশ। বেটারটন যেন অনেকটা আত্মস্থ হয়েছে মনে হলো। আপনার প্রশ্নের উত্তর আমি দিয়েছি। এবার আমার প্রশ্নের জবাব দিন। অলিভের ছদ্মবেশে আপনি এখানে কী করতে এসেছেন?
-অলিভ বলেই সে থেমে গেল। কোন্ কথাটা বলা যায় চিন্তা করতে লাগলো।
–হ্যাঁ, বলুন? অলিভের কী হয়েছে? বলুন? কী বলতে যাচ্ছিলেন বলুন?
বেটারটনের করুণ ত্রস্ত মুখটা দেখে তার বেশ মায়া হলো। বললো, আপনাকে জানাতে ঠিক ভরসা পাচ্ছি না।
তার মানে? আপনি বলতে চাইছেন–তার কোনো বিপদ ঘটেছে?
-হ্যাঁ, আমি দুঃখিত, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি…আপনার স্ত্রী…মারা গেলেন।…আপনার সাথে দেখা করতে আসছিলেন তিনি। পথে প্লেন দুর্ঘটনায় পড়ে, তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানেই তিনি মারা যান।
এবার স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বেটারটন। শান্ত স্বরে শুধু বললো, অলিভ তাহলে মারা গেছে। এবার বুঝতে পারছি…অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে সে হিলারীর দিকে মুখ ফেরালো। ঠিক আছে, বাকিটা একটা নিজেই আন্দাজ করে নিতে পারছি। আপনি তার স্থান দখল করে এখানে এসেছেন, কিন্তু কেন?
এবার কিন্তু হিলারীর জবাব তৈরি। টম বেটারটন বিশ্বাস করেছে যে, তাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবার জন্যই ওকে পাঠানো হয়েছে–অবশ্য ওর কথা যদি সত্যি হয়।
হিলারীর মন বললো, ওর ওপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা বিপজ্জনক হতে পারে। হিলারী বললো, আপনার স্ত্রী যখন মারা যান তখন আমি হাসপাতালে তার পাশে ছিলাম। আমি তাকে বলেছিলাম, আমি আপনার কাছে আসার চেষ্টা করতে পারি। তিনি আপনার একটা খবর পৌঁছে দেবার জন্য খুব উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন।