ও আচ্ছা! গলায় শ্রদ্ধা ফোঁটালো হিলারী।
মিস জেনসেন হিলারীকে নিয়ে ভেতরের ঘরে ঢুকলো। বিশাল ডেস্কের ওপাশ থেকে ডাঃ নিয়েলসন উঠে দাঁড়ালেন। বিশাল দেহ, ধবধবে ফর্সা ভদ্রলোক, হাবভাব অনেকটা গ্রাম্য লোকের মতো।
এগিয়ে এসে করমর্দন করে বললেন, এই তো হা, আপনিই তো মিসেস বেটারটন? আপনাকে আমাদের মধ্যে পেয়ে খুব আনন্দ পেলাম মিসেস বেটারটন। আপনার স্বামী আপনার জন্য দারুণ উৎকণ্ঠায় ছিলেন। এবার এসে পড়েছেন, গুছিয়ে গাছিয়ে নিন।
ধন্যবাদ, ডাঃ নিয়েলসন, হিলারী একটা চেয়ার টেনে বসলো।
ডাঃ নিয়েলসনও তাঁর চেয়ারে বসে একটু ঝুঁকে এলেন। আমাকে কোনো প্রশ্ন করার আছে আপনার? সৌহার্দ্যপূর্ণ প্রশ্ন।
হিলারী হেসে বললো, এটার উত্তর দেওয়াই সবচেয়ে কঠিন। অবশ্য ঠিক উত্তর যদি চান বলবো–এত অজস্ব প্রশ্ন করার রয়েছে যে, কোষ্টা দিয়ে শুরু করবো সেটাই বুঝতে পারছি না।
ঠিক ঠিক, বুঝতে পারছি আমি। আমার উপদেশ যদি শোনেন তাহলে বলবো–স্রেফ নিজের খেয়ালে থাকুন আর যা ঘটছে দেখে যান। এটাই সবচেয়ে ভালো পথ।
এখানকার সম্পর্কে কিছুই জানি না আমি। মাঝে মাঝে মনে হয়–মনে হয় যেন অবাস্তব কিছু
বেশিরভাগ লোকই তাই ভাবে। সাধারণত এখানে আসার আগে একজন হয়তো ভাবে তাকে মস্কোয় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হো হো করে হেসে উঠলেন তিনি। আমাদের এই মরুগৃহ যে-কোনো লোককেই চমকে দেবে।
-আমার কাছে তো এটা একটা দারুণ চমক।
-হতেই পারে, কারণ আগে থেকে কাউকে আমরা কিছু জানাই না। বুঝতেই পারছেন, খোলাখুলি সবকিছু বলে দেওয়া বিচক্ষণতার পরিচায়ক নয়। আসল প্রয়োজন শুধু নির্দেশের। সেইটুকু আমরা শুধু দিয়ে দিই। এখানে কিন্তু আপনি বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই থাকতে পারবেন, যা কিছু আপনার অপছন্দ হবে কিংবা বিশেষ কোনো জিনিষের যদি প্রয়োজন হয়–শুধু একবার আমাদের জানাবেন, আমরা তার ব্যবস্থা করার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। যেমন ধরুন যদি আপনি শিল্পচর্চা, ছবি আঁকা এগুলোর প্রয়োজন মনে করেন তবে সবকিছুরই আলাদা আলাদা বিভাগ আছে আমাদের।
-না না, আমি ওসব বিষয়ে মোটেই পারদর্শী নয়।
–বেশ, এছাড়াও সামাজিক জীবনযাপনের অনেক উপায় রয়েছে। খেলাধুলা নিশ্চয়ই জানেন। এখানে টেনিস কোর্ট, স্কোয়াস কোর্ট সবই রয়েছে। এখানে আসার পর নিজের রাস্তা খুঁজে নিতে কারো দুসপ্তাহ লাগে না বিশেষত স্ত্রীদের। আপনার স্বামীর কাজ রয়েছে, তাই নিয়েই তিনি ব্যস্ত। সুতরাং এক্ষেত্রে অন্যান্য স্ত্রীরা নিজেদের সময় কাটাবার রাস্তা নিজেরাই খুঁজে নেন। আমার কথা বুঝতে পেরেছেন আশাকরি।
-কিন্তু এখানে কি কেউ থাকে?
–এখানে থাকে মানে। আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না, মিসেস বেটারটন।
থাকে মানে–আমি বলতে চাইছি, সবাই কি এখানেই থাকে, নাকি অন্য কোথাও চলে যায়?
ডাঃ নিয়েলসন কেমন যেন উদাস হয়ে গেলেন। বললেন, হুঁ, সেটা নির্ভর করছে আপনার স্বামীর ওপর। হ্যাঁ, এটা অনেকখানি নির্ভর করে তার ওপর। আমি বরং আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছি তিন সপ্তাহ পরে আমার সঙ্গে একবার দেখা করে বলে যাবেন–এখানে কেমন লাগছে?
-আচ্ছা এখান থেকে কেউ কোনোদিন বাইরে যেতে পারে? মানে এই চার দেওয়ালের বাইরে?
খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন। এখানে এসে প্রায় সবাই এই প্রশ্নই করে। কিন্তু আমাদের এই প্রতিষ্ঠান নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জগৎ। এইটাই হচ্ছে আপনার পুরোনো জগৎ যাকে আপনি ফেলে এসেছেন। হ্যাঁ এটা একটা পার্থিব স্বর্গ।
.
১৩.
ঠিক যেন একটা স্কুলের মতো, তাই না? হিলারী বললো, নিজের ঘরে সে আবার ফিরে এসেছে। তার পছন্দ করা জামাকাপড় আর প্রসাধন সামগ্রীগুলো ইতিমধ্যেই বিছানার ওপর, তার অপেক্ষায়। আলমারির মধ্যে জামাকাপড়গুলো ঝুলিয়ে, অন্য জিনিষগুলো সে গুছিয়ে রাখলো।
–আমারও প্রথম প্রথম ঠিক এই কথাই মনে হতো, বেটারটন বললো।
দুজনের কথাবার্তা কেমন যেন ছাড়া ছাড়া ক্লান্তিমাখা। লুকোনো একটা মাইক্রোফোনের সম্ভাবনা তখনও বোঝার মতো তাদের মনে চেপে রয়েছে। কেমন যেন রহস্য ভরা কথা বলছিলো বেটারটন। দেখতেই পাচ্ছো–বেশ আছি, আমি। মাঝে মাঝে মনে হয় স্বপ্ন দেখছি আমি। কিন্তু…
কথাটা সে শেষ করলো না। হিলারী কিন্তু তার না বলা কথাটা বুঝতে পারলো,–কিন্তু আমাদের আরও সাবধান হওয়া উচিত। সমস্ত জিনিষটাই যেন এক অবাস্তব দুঃস্বপ্ন, তাই মনে হচ্ছিলো, হিলারীর। সে এক সম্পূর্ণ অচেনা লোকের সঙ্গে একই শয়নঘরে বাস করছে। কিন্তু তবুও অনিশ্চিত কোনোও বিপদের তীব্র তানভূতির ফলে এই অন্তরঙ্গতাটুকুকে দুজনের কেউই যেন এতটুকুও অশালীন মনে করতে পারেনি।
মিনিট দুয়েকের অস্বস্তিকর স্তব্ধতা ভেঙে, গলাটাকে একেবারে খাদে নামিয়ে বেটারটন বললো, অভ্যস্থ হয়ে নিতে একটু সময় লাগবে, কিন্তু আমাদের খুব স্বাভাবিক ব্যবহার করতে হবে। অত্যন্ত সাধারণ স্বাভাবিক ব্যবহার–যেন এখনও আমরা আমাদের দেশের বাড়িতেই রয়েছি।
কথাগুলোর গভীর তাৎপর্য উপলব্ধি করলো হিলারী। সে ধরেই নিলো, যে অনিশ্চয়তাটুকু অনড় হয়ে রয়েছে তা আরও কিছুক্ষণ থাকবে। বেটারটনের ইংল্যান্ড ত্যাগের কারণ, তার আশা, তার স্বপ্নভঙ্গ এই সমস্ত এই মুহূর্তে আলোচনার প্রয়োজন নেই। এই মুহূর্তে তারা দুজন মাথার ওপর যে অনিশ্চয়তার খঙ্গ ঝুলছে সেই বিপদের বিরুদ্ধে লড়াই করার একই ব্রতে ব্রতী। হিলারী বললো, আমাকে নিয়ে গিয়ে ওরা কত কাণ্ডই না করলো। শারীরিক, মানসিক সব পরীক্ষাই হয়ে গেলো।