তুমি–এখানে সুখে আছো তো? কোনো অসুবিধে হচ্ছে না? চিরন্তনী নারীর অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রশ্ন।
চমৎকার আছি। ভীতসন্ত্রস্ত, অসুখী মুখটাকে আড়াল করে টম বেটারটন মুখে দৃঢ় হাসির রেখা ফোঁটালো। সবরকমের সুবিধে রয়েছে এখানে। একটা পয়সাও খরচ করতে হবে না। নিজের কাজে ডুবে থাকার আদর্শ পরিবেশ। আর এই প্রতিষ্ঠান? অবিশ্বাস্য!
-হ্যাঁ, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই, যেভাবে আমাকে আনা হয়েছে–আচ্ছা, তুমিও কি ওই পথেই এসেছ?
–তা তো জানি না, আমাকে কেউ বলেনি।
–কিন্তু ওই কুষ্ঠরোগী? এটা কি সত্যিই একটা কুষ্ঠোরোগীদের আশ্রম?
–হ্যাঁ, একদল ডাক্তার এদের নিয়ে মূল্যবান গবেষণা চালাচ্ছেন এখানে। কিন্তু ওদিকটা সম্পূর্ণ আলাদা। আসলে এটা একটা সুচতুর আবরণ–বাইরে থেকে যাতে কেউ এখানকার কাজকর্ম সম্বন্ধে একটুকুও সন্দেহ করতে না পারে।
–ও! ঘরের চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো হিলারী। এটাই কি আমাদের বাসস্থান?
-হ্যাঁ, এটা বসবার ঘর। ওদিকে স্নানঘর আর ওপাশে শোবার ঘর। এসো তোমাকে দেখাই ঘরখানা। একপাশে দুটো বড় খাট, তার পাশেই বইয়ের আলমারি। ওপাশে পোশাক রাখার দেওয়াল-আলমারি। একটা ড্রেসিং টেবিল। পোশাকের আলমারিটা খুলে তার বিশাল গহ্বরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো হিলারী। এতে কি রাখবো তাই ভেবে পাচ্ছি না। জামাকাপড় বলতে তো এই যা পরে আছি, তাই সব।
সেজন্য ভেবো না, যেমন খুশি পোশাকে ভরিয়ে ফেলতে পারো আলমারি। এখানে বিরাট একটা সাজসজ্জার বিভাগ আছে। জামাকাপড়, প্রসাধনসামগ্রী, সবকিছু পাবে সেখানে। দামীদামী জিনিষ সব। এখানকার এই সংস্থা সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরশীল। যা কিছু প্রয়োজন সব পাবে এখানে –কোনোদিনের জন্য একবারও বাইরে যাবার দরকার হবে না। টম বেটারটন খুব সহজভাবে বললেও হিলারী কথাটাকে এত সহজভাবে নিলো না।
কোনোদিনের জন্য বাইরে যাবার দরকার হবে না, আসলে কোনোদিনও বাইরে যাবার উপায় নেই। তোমরা যারা ভেতরে এসেছ ফেরার আশা ত্যাগ করো। শুধু কি এরই জন্য এত গুণী জ্ঞানী লোকগুলো তাদের দেশ, ঘর, সংসার সব ছেড়ে চলে এসেছে। ভেবে কূল পেলো না হিলারী! এই যে ডাঃ ব্যারন, অ্যান্ড্রু পিটার্স, স্বপ্নিল মুখ এরিকসন, হেলগা নীডহেইম এরা কি জানে কী জন্য তারা এখানে এসেছে? ওরা কি সন্তুষ্ট হবে এসব দেখে? এটাই কি ওরা চেয়েছিলো?
মনে মনে সে ভাবলোনা, বেশি প্রশ্ন না করাই ভালো…হয়তো কেউ অলক্ষে তাদের কথাবার্তা শুনছে!
সত্যিই কি কেউ শুনছে? সত্যিই কি কেউ ওদের ওপর কড়া নজর রাখছে?
টম বেটারটন বললো, তুমি কি বিশ্রাম নিতে চাও?
–না, মানে, হিলারী বললো, তার দরকার নেই।
–তাহলে বরং চলো, রেজিস্ট্রি ঘর থেকে ঘুরে আসি।
–রেজিস্ট্রি ঘর কি জিনিষ?
–এখানে যারা আসে তাদের প্রত্যেককেই এই রেজিস্ট্রি ঘর হয়ে আসতে হয়। ওরা তোমার সবকিছু ওখানে নথিভুক্ত করে রাখবে।
-ও বাবা! এ যে মিলিটারি আদব-কায়দা–নাকি ডাক্তারি ব্যাপার?
–দুই-ই–টম বেটারটন বললো।
হিলারী বললো, লোকমুখে তাই শোনা যায় বটে; মানে আমি বলতে চাইছি, লৌহ যবনিকার অন্তরালে সত্যিই সবকিছু একেবারে ছক বেঁধে পাকাঁপোক্ত ভাবে তৈরি। কে বলতে পারে, হয়তো অলিভ বেটারটনের কিছুটা সহানুভূতি ছিলো এই দল সম্পর্কে; যদিও সে এই দলের সদস্য নয় বলেই জানা গেছে।
বেটারটন বললো, এখানে অনেক কিছু জানার আছে তোমার। এখুনি সবকিছু জানার চেষ্টা না করাই ভালো। কানের কাছে বেটারটন হিলারীকে ফিসফিস করে বললো, এসব আলোচনা করো না, তারপর গলা চড়িয়ে বললো, এবার তাহলে চলো, রেজিস্ট্রি ঘর থেকে ঘুরে আসি।
.
১২.
রেজেস্ট্রি ঘরের অধ্যক্ষ একজন মহিলা। দেখে বেশ কড়া স্কুল মাস্টারনী মনে হয়। চুলগুলো গুটিয়ে মাথার পেছনে খোঁপা করা। নাকের ওপর একটা চশমা। বেটারটনকে ঘরে ঢুকতেই বললেন, মিসেস বেটারটনকে একেবারে সঙ্গে নিয়ে এলেন? তা ভালোই করেছেন।
বিশুদ্ধ ইংরেজি উচ্চারণ, কিন্তু তবুও যেন হিলারীর মনে হলো উনি ইংরেজ নন। সত্যিই উনি সুইজারল্যান্ডের মেয়ে। ভদ্রমহিলা হিলারীকে বসতে ইঙ্গিত করে, কতকগুলো কাগজে কী সব লিখতে লাগলেন। টম বেটারটন উসখুস করে বললো, তাহলে অলিভ–আমি এখন যাই।
–কিছু যদি না মনে করেন, সেটাই ভালো হবে, মিঃ বেটারটন, ভদ্রমহিলা বললেন।
দরজাটা টেনে নিয়ে টম বেটারটন বেরিলয়ে গেলো। ভদ্রমহিলা যন্ত্রের মতো ঘাড় হেঁট করে লিখেই চললেন। লেখা শেষ করে বললেন–বেশ, এবার বলুন, আপনার পুরো নাম, বয়েস, কোথায় জন্ম, বাবা, মায়ের নাম, বড় রকমের কোনো অসুখ আছে কিনা, রুচি, শখ, কোথাও চাকুরি করে থাকলে তার বর্ণনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো উপাধি আছে কিনা। খাদ্য এবং পানীয়ের মধ্যে কোন্ কোন জিনিষ পছন্দ।
হাজারো প্রশ্ন। হিলারী ভাসাভাসা জবাব দিয়ে চললো। জেসপের কাছ থেকে শিক্ষাগুলো সযত্নে কাজে লাগাতে পেরে খুশি হলো হিলারী।
ভদ্রমহিলা কাগজে লিখে মাথা তুললেন। বেশ, এই দপ্তরের সব কাজ মিটলো মনে হচ্ছে। এবার আপনাকে ডাক্তার স্কুয়াংজের কাছে যেতে হবে–শারীরিক পরীক্ষার জন্য।
হিলারী বললো, সত্যিই এসবের দরকার আছে? কেমন যেন অদ্ভুত মনে হচ্ছে আমার।
সবকিছু খুঁটিয়ে যাচাই করাই আমাদের পছন্দ, মিসেস বেটারটন। সবকিছু পাকাপাকি নথিভুক্ত করাই অভ্যাস আমাদের। চলুন–ডাক্তার স্কুয়ার্জকে আপনার বেশ ভালোই লাগবে। ওখান থেকে ডাঃ রুবেকের কাছে চলে যাবেন।