-এই যে বেটারটন-শেষ পর্যন্ত সত্যিই আমরা এসে পড়লাম। তোমার স্ত্রী-বলে হিলারীকে ভেতরে যাবার পথ করে দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়ালেন ভ্যান হিদেম।
ঘরে ঢুকলো হিলারী। না–ভয় করছে না আর। হাতে-পায়ে খিলও ধরছে না আর। থুতনি উঁচু করে সে এগিয়ে চললো অন্ধকার গহ্বরের দিকে।
অপূর্ব সুন্দর একজন জানালার কাছে ঘাড় ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একনজর পুরুষের রূপে মুহূর্তের জন্য মুগ্ধ গয়ে গেলো হিলারী। কিন্তু টম বেটারটনকে যেমন দেখতে ভেবেছিলো এ যেন তেমন দেখতে নয়। না–অন্তত তাকে যে ছবি দেখানো হয়েছিলো, সেরকম তো নিশ্চয়ই নয় তবে?
এই বিভ্রান্তিকর চমকই তাকে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিলো। এবার সে সর্বশক্তি দিয়ে, সাংঘাতিক কৌশলটাকে কাজে লাগাবে।
হঠাৎ সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে আবার পিছিয়ে এসে চিৎকার করে বললো, না–এ টম নয়। এ আমার স্বামী নয়…।
অভিনয়টা এমন চমৎকার হয়েছে সে মনে মনে নিজেকে তারিফ করলো।
টম বেটারটন হো হো করে হেসে উঠলো। চমৎকার! চমৎকার-তাই না ভ্যান হিদেম। এত চমৎকার যে আমার নিজের স্ত্রীও আমাকে চিনতে পারছে না। দ্রুত কয়েক-পা এগিয়ে এসে সে হিলারীকে জড়িয়ে ধরে বললো–অলিভ, আমার অলিভ। তুমিও আমাকে চিনতে পারছো না? আমি টম–সত্যিই টম–যদিও আমার মুখটা এখন আর আগের মতো নেই, তবুও সত্যিই আমি টম। আবেগে তার গলা জড়িয়ে এলো। হিলারীকে খুব আদর করতে লাগলো এবং ফিসফিস করে বললো, অভিনয় করে যাও। দোহাই তোমার! সাংঘাতিক বিপদ!
গলার পাশে টমের আঙুলের চাপে বিপদবার্তা শুনতে পেলো হিলারী। যেন তাকে সতর্ক করে দিচ্ছে, অত্যন্ত জরুরী বার্তায় তাকে সাবধান হতে বলছে।
কিছুক্ষণ পরেই টম তাকে ছেড়ে দিলো। একটু পিছিয়ে এসে সোজা তার মুখের দিকে তাকালো। এ আমি–এখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না, অলিভ। সত্যিই তুমি এলে? এবার বলল আমাকে চিনতে পারছো তোতা?
কিছু বুঝতে পারছে না হিলারী কিছু বুঝতে পারছে না, কিন্তু তবুও যেন কোন্ অলৌকিক শক্তিবলে সে সত্যিকারের অলিভ বনে গিয়ে বললো-ওঃ টম্! এই ডাকটুকুর মধ্যেই সে যেন মনের সবটুকু আবেগ ঝরিয়ে ফেললো। টম, ওঃ!–কিন্তু তোমার মুখ
অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। ভিয়েনার হার্জ স্বয়ং এখানে আছেন। আরো জানাই তো, তিনি একজন জীবন্ত বিস্ময়! এবার অনেক সহজভাবে আলতো করে সে চুম্বন করলো। তারপর মুখ ঘুরিয়ে ভ্যান হিদেমের দিকে তাকিয়ে বললো, একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম, ক্ষমা করো ভ্যান।
-আরে না না, এ তো খুব স্বাভাবিক।
কত-কত দিন পর, ওঃ। হিলারী বললো, আর আমি একটু যেন টলে উঠলো সে, আমি একটু বসতে পারি!
টম বেটারটন তাড়াতাড়ি তাকে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলো, আরে ছি ছি, বসো। আমার খেয়ালই ছিলো না। এই কদিনের গাড়ির ধকল আর সেই প্লেন দুর্ঘটনা–খুব কষ্ট গেছে তোমার। ঈশ্বর করুণাময়, তাই তোমাকে ফিরে পেয়েছি।
আচ্ছা–তাহলে সব খবরাখবরই এখানে পৌঁছে গেছে। প্লেন দুর্ঘটনার কথাও এরা জানে। হিলারী বললো, হ্যাঁ, পেন দুর্ঘটনা আমাকে বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দিয়েছে। মাঝে মাঝে অনেক কথা মনে করতে পারি না। সব যেন গুলিয়ে যায় তার ওপর আবার মাথায় যন্ত্রণা। তোমাকে দেখে তাই প্রথমে সম্পূর্ণ অপরিচিত লোক মনে হয়েছিলো, কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিলো। আমাকে নিয়ে তুমি অস্বস্তিতে পড়বে না তো?
তোমাকে নিয়ে অস্বস্তিতে পড়বো? কি বলছো তুমি! কক্ষনো না, তুমি শুধু ব্যাপারটাকে একটু সহজভাবে নেবার চেষ্টা করো তাহলেই হবে।
ভ্যান হিদেম দরজার দিকে এগোলেন। আমি এবার যাই, বেটারটন, একটু পরে তুমি তোমার স্ত্রীকে নিয়ে রেজিষ্ট্রি ঘরে আসতে পারবে তো? এখন কিছুক্ষণ তোমাদের একা থাকা উচিত-দরজাটা টেনে দিয়ে তিনি বেরিলয়ে গেলেন।
সঙ্গে সঙ্গে বেটারটন হিলারীর পাশে হাঁটু গেড়ে বসলো। তার কাঁধে মুখ ডুবিয়ে বলতে লাগলো, সোনা, সোনা আমার
আবার হিলারী তার আঙুলের চাপে বিপদ সংকেত অনুভব করলো। আবার ফিসফিস করে বললো, অভিনয় করে যান। ঘরের মধ্যে কোথাও লুকানো মাইক্রোফোন বা অদৃশ্য চোখ থাকতে পারে।
সত্যিই–থাকাটা স্বাভাবিক। আছে কিনা কে বলতে পারে…। ভয়–অস্বস্তি–অনিশ্চয়তা প্রতি মুহূর্তে বিপদ, ঘরের আবহাওয়ায় এগুলো যেন স্পষ্ট অনুভব করলো হিলারী।
টম বেটারটনও কোলে মাথা রেখে মুখের দিকে তাকালো। তোমাকে দেখতে কী ভালোই না লাগছে। মনে হচ্ছে যেন স্বপ্ন সত্যি নয়। তোমারও কি তাই মনে হচ্ছে?
–হ্যাঁ, ঠিক এই কথাই মনে হচ্ছে। এখানে আসা শেষপর্যন্ত তোমার পাশে। সবটাই যেন স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে আমার। এটাকে সত্যি বলে বিশ্বাসই করতে পারছি না টম। টমের দুকাঁধে আলতো হাত রেখে সে তার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি হাসলো। কে জানে-মাইক্রোফোনের মতো হয়তো অলেক্ষ্য কেউ তাদের লক্ষ্যও করছে।
টম বেটারটনের দিকে তাকিয়ে সে স্বস্তি বোধ করলো। তিরিশের ওপর বয়স–অপূর্ব সুন্দর চেহারার মানুষটার মধ্যে কেমন যেন একটা বোকা বোকা ভীতচকিত ভাব।
প্রথম বাধাটা সে অতিক্রম করেছে নিজের অভিনয় ক্ষমতায় অদ্ভুত আনন্দে ভরে উঠলো হিলারীর বুক। হ্যাঁ, তাকে অলিভ বেটারটন হতেই হবে। অলিভের মতো চিন্তা করলে, অলিভের মতো কাজ করলে তবেই না অলিভ বেটারটন হতে পারবে।