মিস হেদারিংটন যদি জেসপের পাঠানো গুপ্তচর হয়, তাহলে মিস হেদারিংটনও ম্যারাকেশে এদের কাছে বুদ্ধ বনে ফিরে গেছে। কী-ই বা করতে পারতো।
ভ্রমণার্থীদের দলটা এমন এক জায়গায় এসে পড়েছে যেখান থেকে ফেরার কোনো পথ নেই। হিলারী নিজের জীবন নিয়ে জুয়া খেলছিলো, হেরে গেছে। সে এখন আর কিছুতেই মরতে চায় না। সে মনে মনে ভাবছিলো, আমি আবার বেঁচে উঠবো, সম্পূর্ণ সুস্থ, পুরোপুরি একজন নারী..কিন্তু এখন–ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো ছটফট করছি আমি, পালাবার মতো একটা পথও যদি ভোলা থাকতো।…
নিজের চিন্তায় মগ্ন থাকলেও আসল সমস্যার কথা মোটেও ভোলেনি। কিন্তু বারবার মনে হয়েছে যখনই তার বেটারটনের সঙ্গে দেখা হবে তখনই সব শেষ হয়ে যাবে…বেটারটন হয়তো বলবে এ তো আমার স্ত্রী নয়–আর একথা বলা মানেই ব্যস। সবকিছুই পরিষ্কার হয়ে যাবে।
বাইরে থেকে আসা ছোট দলটিকে একজন বিশালদেহী পুরুষ অভ্যর্থনা জানালেন। তাকে দেখে দোভাষী মনে হলো কেননা সবার সাথেই তিনি দু-একটা কথা বললেন, তাদেরই ভাষায়। ডাঃ ব্যারনকে দেখে বললেন, ডাক্তার আপনার জ্ঞানের কথা অনেক শুনেছি। আপনাকে আমাদের মধ্যে পেয়ে আমরা কৃতার্থ। তারপরেই হিলারীর দিকে ফিরে বললো, আরে মিসেস বেটারটন! আপনাকে এখানে পেয়ে আমরা ভীষণ আনন্দিত। পথের ধকলে খুব কষ্ট পেয়েছেন? আপনার স্বামী খুব ভালো আছেন আর স্বভাবতই আপনার আসার জন্য উৎকণ্ঠায় প্রহর গুনছেন।
অদ্ভুত হাসি হেসে বললো, আপনিও নিশ্চয়ই তার সঙ্গে দেখা করার জন্য খুবই উদ্বিগ্ন।
মনের অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে। পাশ থেকে অ্যান্ড্রু পিটার্স তার কাঁধে হাত রেখে যেন সাহস জোগালো। ভদ্রলোককে বললো, আমার মনে হচ্ছে মিসেস বেটারটন যে ক্যাসাব্লাঙ্কায় প্লেন দুর্ঘটনায় পড়ে মাথায় চোট পেয়েছিলেন, সেটা আপনি শোনেননি! অচিরেই স্বামীকে দেখার উত্তেজনাটাও ওঁর পক্ষে বোধহয় ভালো হবে না। আমি বলবো, এই মুহূর্তে একটা অন্ধকার ঘরে গিয়ে ওঁর শুয়ে পড়া উচিত। পিটার্সের গলায় আর হাতের চাপে স্পষ্ট সহানুভূতির ছোঁয়া পেলো হিলারী। মনটা আবারও যেন একটু দুলে উঠলো। এই মুহূর্তে এদের চোখের সামনে–সারাদেহ অবশ করে ধীরে ধীরে ঢলে পড়া কত সহজ..আস্তে আস্তে হাঁটু দুমড়ে পড়বে…অজ্ঞানের ভান করতে পারবে সে।
সাহস ফিরে পেলো হিলারী, পা-দুটোকে সোজা করে দাঁড় করালো, ফ্যাকাসে মুখে তাবার রক্ত চলাচল শুরু হলো, সে নিজেই বেটারটনের কাছে যাবে, আর সে যখন তাকে নিজের স্ত্রী বলে মানতে অস্বীকার করবে তখন সে তার শেষ মিথ্যে কথাটা ছুঁড়ে দেবে–অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে নির্ভয়ে জবাব দেবে সে। না, নিশ্চয়ই আমি আপনার স্ত্রী নই, আপনাকে দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি আপনার স্ত্রী মারা গেছেন। তার মৃত্যুর সময় আমিও সেই হাসপাতালে ছিলাম। আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম যে-করেই হোক আমি আপনার কাছে তার শেষ কথাগুলো পৌঁছে দেবো। তাই করছিলাম আমি।
গা-ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো হিলারী। এখন আর পিটার্সের আশ্বাসের প্রয়োজন নেই তার। বললো, না-না, আমি টমের সঙ্গে দেখা করবো। এক্ষুনি তার কাছে আমায় নিয়ে চলুন–প্লিজ–এক্ষুনি।
ভদ্রলোক হিলারীর মনের কথা বুঝে বললেন, নিশ্চয়, নিশ্চয়ই মিসেস বেটারটন, আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি আমি। এই যে মিস জেনসেন এসে গেছেন।
চশমা পরা রোগামতন একটি মেয়ে এসে ওঁদের সঙ্গে যোগ দিল। ভদ্রলোক আমাদের সবার সাথে মেয়েটিকে আলাপ করিয়ে দিলেন। মেয়েটিকে বললেন, আপনি এদের রেজিষ্ট্রি ঘরে নিয়ে যান আমি মিসেস বেটারটনকে নিয়ে ওঁর স্বামীর কাছে পৌঁছে দিয়ে চলে আসবো।
ভদ্রলোকের পিছু পিছু চললো হিলারী। বারান্দার বাঁকের মুখে একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো অ্যান্ড্রু পিটার্স তখনও তাকে লক্ষ্য করছে। হিলারীর মনে হলো, ও হয়তো কিছু একটা সন্দেহ করেছে, হয়তো তার ব্যবহারে এমন কিছু বুঝেছে যাতে কোনো অশুভ চিন্তা করেছে–অথচ কী যে অশুভ চিন্তা তা বুঝতে পারছে না। বাঁকের মুখে অদৃশ্য হবার আগে হিলারী হাত নেড়ে তাকে বিদায় জানালো।
ভদ্রলোক হিলারীকে ডাকলেন, এইদিকে আসুন মিসেস বেটারটন। প্রথম প্রথম এই বাড়িটাকে আপনার গোলকধাঁধার মতো মনে হবে। অজস্র বারান্দা, সবগুলো প্রায় একইরকম।
স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিলো হিলারীর। ঝকঝকে সাদা বারান্দা এখান দিয়ে স্বপ্নের ঘোরে ঘুরে বেড়াও কিন্তু বেরোবার পথ কোনোদিনই খুঁজে পাবে না…। বললো, এটা যে একটা হাসপাতাল আমি ভাবতেও পারিনি।
-না না, বটেই তো, কিছুই বোঝার কথা নয় আপনার, তাই না? গলায় প্রচ্ছন্ন কৌতুক। চোখ ধাঁধিয়ে যায় এখানে। হ্যাঁ, ভালো কথা, আমার নাম ভ্যান হিদেম। পল ভ্যান হিদেম।
–সবকিছুই যেন কেমন এখানে–ভীতিকরও বটে। ওই কুষ্ঠরোগীরা
-হা, ঠিকই বলেছেন, এখানে সবকিছুই যেন ছবির মতো। নতুন কেউ এলে ঘাবড়ে যেতে বাধ্য। কিন্তু এও আপনার অভ্যাস হয়ে যাবে। ভ্যান হিদেম হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, আসুন, এই সিঁড়িটা উঠলেই–উঁহু ব্যস্ত হবেন না। স্থির হোন এই তো পৌঁছে গেছি আমরা।
হ্যাঁ, এই তো পৌঁছে গেছি–পৌঁছে গেছি মৃত্যুর ঠিকানায়…আর মাত্র একটা ধাপ…ওপরে… ওপরে…গভীর…খাড়াই সিঁড়ি…ইউরোপীয় সিঁড়ির চেয়ে অনেক বেশি খাড়াই সিঁড়ি…পৌঁছে, গেছি। আর ওই তো। আরেকটা বারান্দা পেরিয়ে একটা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ভ্যান হিদেম। দরজায় টোকা দিয়ে একটু অপেক্ষা করলো-তারপর দরজা খুলে ফেললো।