ডাঃ ব্যারনও এগিয়ে এসে বললেন, এখনও আপনাদের মনের জোর আছে তো? নাকি আপনারা ওই মার্কিনী বন্ধুটির সঙ্গে প্লেনে উঠে নিজের চেনা জগতে ফিরে যেতে চাইছেন?
-ইচ্ছে করলেই কি যেতে পারবো? হিলারী বললো।
–কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফরাসি ভদ্রলোক বললেন, কী জানি!
–ওঁকে ডাকবো? অ্যান্ড্রু পিটার্স জিজ্ঞেস করলো।
হিলারী উত্তর দিলো, কক্ষনো না।
হেলগা নীডহেইম ব্যাঙ্গ করে বললো, দুর্বলচিত্ত মেয়েদের এখানে আসা কেন?
–মোটেই উনি দুর্বলচিত্ত মেয়ে নন, ডাঃ ব্যারন জবাব দিলেন। উনি নিজের কাছেই কিছু জবাব চেয়েছেন, যা যে-কোনো বুদ্ধিমতী মেয়েই করে।
এরিকসন তখন বলেছেন, হুঃ, স্বাধীনতার দোরগোড়ায় এসে লোকে ফিরে যাবার কথা ভাবে কী করে!
হিলারী এবার না বলে পারলো না, যদি ফিরে যাবার উপায় না থাকে অথবা ফিরে যাবার চিন্তা করার স্বাধীনতা না থাকে, তবে এ স্বাধীনতা স্বাধীনতাই নয়।
এই সময়ে ভৃত্য এসে জানালো গাড়ি তৈরি।
বাইরে এসে ওরা দেখলো, দুটো ক্যাডিলাক গাড়ি, পাশে দাঁড়িয়ে দুজন ধোপদুরস্ত চালক। হিলারী চালকের পাশে সামনের আসনে বসতে চাইলো। বড় গাড়ির পেছনের ঝাঁকুনিতে গা গুলোয় তার। গাড়িতে বসে টুকিটাকি কথা বললো হিলারী, কী চমৎকার আবহাওয়া–সুন্দর গাড়িটা–স্বচ্ছন্দ ফরাসিতে সে বলছিলো, ড্রাইভার খুশি হয়ে জবাব দিচ্ছিলো। এবার সে জিজ্ঞেস করলো, আর কতক্ষণ লাগবে যেতে?
বিমানবন্দর থেকে হাসপাতাল? তা–প্রায় ঘন্টাদুয়েকের রাস্তা মাদাম।
হিলারী চমকে উঠলো, হাসপাতাল! তাই হবে বোধহয়। এখন মনে হচ্ছে হেলগা নীডহেইম আগেই নার্সের পোশাক পরে নিয়েছে সম্ভবতঃ এই জন্যই। ড্রাইভারকে বললো, হাসপাতালটা কেমন আমাকে একটু বলো।
–সে মাদাম–চমৎকার। পৃথিবীর আধুনিকতম যন্ত্রপাতি, সাজসরঞ্জাম রয়েছে এখানে। কত বড়বড় ডাক্তার আসেন এই হাসপাতাল দেখতে আর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ফিরে যান। মানবজাতির কল্যাণের জন্য এখানে যা করা হচ্ছে-অতুলনীয়।
-তা তো হতেই হবে-হা হা তাই তো হওয়া উচিত।
–কী যন্ত্রণাময় জীবন এদের-ড্রাইভার বললো। আগেকার দিনে নির্জন দ্বীপে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে মরার জন্য পাঠানো হতো এদের। কিন্তু এখানে, ডাঃ কোলিনির চিকিৎসায় প্রায় সবাই রোগমুক্ত হচ্ছে। এমনকি শেষ অবস্থা থেকেও অনেকে সেরে উঠেছে।
হিলারী বললো, হাসপাতালের পক্ষে জায়গাটা খুবই নির্জন বলে মনে হচ্ছে।
–হ্যাঁ, মাদাম, কিন্তু এইরকম পরিস্থিতিতে নির্জন জায়গাই তো বেছে নিতে হবে। ওপরওয়ালারাই এই বন্দোবস্ত করেছেন। কিন্তু জল হাওয়া খুব ভালো এখানে, চমৎকার বাতাস। ওই যে, এইবার দেখুন মাদাম, আমরা কোথায় যাচ্ছি।
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে হিলারী দেখলো, অদূরে পর্বতমালা, সেইদিকেই দ্রুত চলেছে ওরা। পাহাড়ের ওপাশে একটা বিরাট সাদা ঝকঝকে অট্টালিকা।
-ওঃ, এখানে এমন একটি বাড়ি তৈরি করা কি চাট্টিখানি ব্যাপার, ড্রাইভার বলতে লাগলো। কতকত্তো টাকা যে খরচ করা হয়েছে। সরকারী কাজের মতো সস্তা কাজ নয়। জলের মতো টাকা ঢেলেছে। ওরাও বলেন–আমাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী লোকেদের একজন। ঠিকই বলেন, নিজের চোখেই দেখুন–মানবজীবনের দুঃখমোচনের জন্য কী বিরাট প্রতিষ্ঠান গড়েছেন।
আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে গাড়ি উঠে একটা বিরাট উঁচু লোহার ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালো।
এখানেই আপনাদের নেমে যেতে হবে, মাদাম। ভেতরে গাড়ি নিয়ে যাবার হুকুম নেই।
নেমে পড়লো ওরা। ফটকের গায়ে ঘন্টা বাজাবার দড়ি ঝুলছে। কিন্তু দড়িটা ছোঁয়ার আগেই দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে গেলো। সাদা পোশাক পরা একজন লোক হাসিমুখে তাদের ভেতরে যেতে ইঙ্গিত করলো। দরজা দিয়ে ঢুকে, একপাশে উঁচু তারের জাল দিয়ে ঘেরা একটা বাগান। সেখানে কয়েকজন পায়চারি করছে। আগন্তুকদের দেখার জন্য তারা মুখ ফেরাতেই, হিলারীর গলা দিয়ে চাপা আতঙ্কের একটা চিৎকার ফেটে পড়তে চাইলো, ওকি! ওরা যে কুষ্ঠরোগী! কুষ্ঠরোগী!
আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠলো হিলারী।
১১. কুষ্ঠরোগীদের আশ্রয়
১১.
কুষ্ঠরোগীদের আশ্রয়-শিবিরের বিরাট ফটকটা অভিযাত্রীদের পেছনে যান্ত্রিক শব্দ তুলে আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেলো। শব্দটা হিলারীর হতচেতন স্থাণু মনের ওপর যেন কেটে কেটে বসলো। শব্দটা যেন এই কথাই বলে গেলো, আশা ত্যাগ করো-তোমরা যারা ভেতরে এসেছে–ফেরার আশা ত্যাগ করো…এইবার সব শেষ, ভাবলো হিলারী…সত্যিই এবার সব শেষ, ফিরে যাবার শেষ পথটুকুও রুদ্ধ হয়ে গেলো।
শত্রুদের মাঝে সে এখন সম্পূর্ণ একা। কিছুক্ষণ পরই আবিষ্কার আর ব্যর্থতার মুখোমুখি হতে হবে তাকে। অবচেতন মনে এই কথাটাই তার বারবার মনে হয়েছে। তবুও মানুষের আশা আর মনের জোর দিয়ে সে বারবার চিন্তাটাকে ঠেকিয়ে রেখেছে। ক্যাসাব্লাঙ্কায় সে একবার জেসপকে জিজ্ঞেস করেছিলো, টম বেটারটনের সামনে যখন হাজির হবো, তখন কী ঘটবে?
জেসপ বলেছিলেন, সেটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক মুহূর্ত। তিনি আশা করেন, তার মধ্যেই তাকে রক্ষা করার মতো অবস্থা হয়তো তিনি সৃষ্টি করবেন, কিন্তু সেই আশা করেন, তার মধ্যেই তাকে রক্ষা করার মতো অবস্থা হয়তো তিনি সৃষ্টি করবেন, কিন্তু সেই আশা আশাই রয়ে গেলো। বুঝতে অসুবিধা হলো না হিলারীর, সেই আশা ব্যর্থ হয়ে গেছে।