জেসপ ক্লান্তির হাসি হেসে বললেন, হ্যাঁ, তাই হবে হয়তো, সবচেয়ে বড় কথা–এরা মনে করে যে, এরা অনেক কিছু জানে। কিন্তু আমাদের ধাঁচটাই আলাদা। সারা দুনিয়ার রক্ষার কথা চিন্তা করি না। শুধু দু-একটা টুকরো নিয়ে, কোনো কাজকর্ম আটকে গেলে তার কলকজাগুলোকে ঢিলে করে দিলেই আমাদের কর্তব্য শেষ। তিনি চিন্তিতভাবে বললেন, শুধু বেটারটন সম্পর্কে যদি বিশদ জানতে পারতাম। তার জীবন সম্পর্কে জানতে চাই না, তার কাজকর্মের কথাও না–কয়েকটা খুঁটিনাটি কথা। কী ধরনের রসিকতা তার ভালো লাগতো, কোন্ কোন্ কথা তিনি হলফ করে বলতে পারতেন, কার প্রশংসা করতেন এবং কে তাঁকে পাগল করে তুলেছিলো ব্যাস।
হোয়ারটন অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ওর স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছ?
-অজস্রবার।
–তিনি কোনো সাহায্য করতে পারেন না?
জেসপ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, এখনো তো পারেননি।
-তোমার কি ধারণা–উনি কিছু জানেন?
-কিছু জানেন এটা অবশ্য তিনি স্বীকার করেননি। স্রেফ প্রতিক্রিয়াগুলো প্রকাশ পেয়েছে –চিন্তা, দুঃখ আর আকুল উদ্বেগ। স্বামীর জীবনযাত্রা ছিল স্বাভাবিক, মানসিকতার লক্ষণ ছিল না, এছাড়া কোনো সূত্র বা সন্দেহের কথা বলতে পারেন না। তবে তার নিজস্ব মতামত তার স্বামীকে গুম করা হয়েছে।
–আর তোমার সেটা বিশ্বাস হয় না–এই তো?
–আমি কখনো কাউকে বিশ্বাস করি না–এ বিষয়ে আমার অক্ষমতার কথা স্বীকার করছি।
হোয়ারটন বলতে লাগলেন-ও আচ্ছা! আমার মনে হয় সবকিছু ভোলামেলা আলোচনা করাই ভালো। মহিলাটি কেমন?
–একদম সাধারণ মহিলা, যে-কোনো দিন দেখা যাবে তাসের আড্ডায় ব্রিজ খেলছেন।
কিছু যেন বুঝতে পেরেছেন এমনভাবে মাথা নাড়লেন হোয়ারটন। তার মানে ব্যাপারটা আরো জটিল হয়ে পড়লো।
ভদ্রমহিলা এখনই আমার কাছে আসবেন। দেখি, আর একবার পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটা যাক।
–হ্যাঁ, এটাই একমাত্র উপায়। এসব কাজ আমার দ্বারা হয় না কারণ আমার ধৈর্য কম। হোয়ারটন উঠে পড়লো। ঠিক আছে, তোমাকে আটকাবো না। আমার তো মনে হয় বেশিদূর এগোইনি, কি বলো?
–দুভাগের বিষয় না–তুমি অসলো থেকে পাঠানো খবরটা ভালো করে দেখো। এটাই সম্ভাব্য জায়গা।
হোয়ারটন বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর জেসপ ফোন তুলে মিসেস বেটারটনকে ওঁর ঘরে পাঠিয়ে দেবার কথা বললেন।
জেসপ ছাদের দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। দরজায় মৃদু টোকা দিয়ে মিসেস বেটারটন ঘরে ঢুকলেন। সাতাশ বছর বয়স, দীর্ঘাঙ্গী মহিলা। মাথায় সোনালি চুল দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সোনালি চুলের সৌন্দর্যে মুখখানা দেখার যেন প্রয়োজনই হয় না। মুখের উপর লালচে একখানা –এবং তার নিচে সবুজ একজোড়া চোখ। জেসপ লক্ষ্য করলেন–ভদ্রমহিলা কোন প্রসাধন ব্যবহার করেননি। ভদ্রমহিলাকে বসতে বলেজেসপের মনে ক্ষীণ একটা আশার আলো দেখা দিল। মনে হলো মিসেস বেটারটন আরো কিছু বেশি জানেন।
তিনি নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, দুঃখে কাতর কোনো মহিলা প্রসাধন করতে ভোলে না। বেদনার ক্ষতগুলো ভেসে উঠলে সেগুলিকে প্রলেপ দিয়ে আড়াল করতে চায়। অথচ মিসেস বেটারটনের ক্ষেত্রে সেটা হলো না কেন? মিসেস বেটারটন কি ইচ্ছে করেই প্রসাধন ব্যবহার করেননি যাতে একজন বিরহিণী স্ত্রীর ব্যথাতুর মুখটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মিসেস বেটারটন জেসপকে জিজ্ঞেস করলেন, অনেক আশা নিয়ে এসেছি আমি কোনো খবর আছে?
জেসপ নম্রস্বরে ঘাড় নেড়ে সান্ত্বনা দিলেন। আপনাকে আরেকবার ডেকে আনার জন্য খুব দুঃখিত, আপনাকে নিশ্চিত কোনো খবর দেবার নেই বলে আমার লজ্জা করছে।
অলিভ বেটারটন বললেন, আমি জানি। আপনি এই কথা আমাকে চিঠিতে লিখেও জানিয়েছেন। তবু একবার এলাম, এতদিন হলো যদি কোনো খবর থাকে। সারাদিন বাড়িতে বসে চিন্তা করা–সে যে কী ভয়ঙ্কর। এ ব্যাপারে কারো কিছু করার নেই–এটা ভেবে আরো খারাপ লাগে।
জেসপ নম্রস্বরে বললেন, মিসেস বেটারটন, আশা করি, আমি যদি আপনাকে একই কথা একই প্রশ্ন কিংবা একই বিষয়ের উপর জোর দেই তাতে আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে এর মধ্যে থেকে একটা মূল্যবান কথা যা আপনার মনে পড়েনি বা উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করেননি, সেই কথাটা বেরিলয়ে আসতে পারে।
-হ্যাঁ, আমি বুঝতে পেরেছি। আপনি আবার প্রথম থেকে জিজ্ঞেস করুন।
–আচ্ছা, আপনি আপনার স্বামীকে শেষ দেখেন–গত ২৩শে আগস্ট, তাই তো?
–হ্যাঁ।
তার মানে–প্যারিসে এক সম্মেলনে যোগ দেবার জন্য যেদিন তিনি ইংল্যান্ড ত্যাগ করেন, সেইদিন।
–হ্যাঁ।
জেসপ এবার দ্রুত বলতে লাগলেন, সম্মেলনে প্রথম দুদিন উপস্থিত ছিলেন, তৃতীয় দিন অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি তার এক সহকর্মীকে সম্মেলনে না গিয়ে ব্যাটো ম্যাস-এ চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
-ব্যাটো ম্যাস? ব্যাটো ম্যাসটা কী জিনিস?
জেসপ হেসে বললেন, যেমন নদীতে ছোট ছোট নৌকো তির তির করে ঘুরে বেড়ায়। ভ্রমণার্থীদের বিশেষ আকর্ষণের জন্য এই ব্যাপারটা আপনার স্বামীর পক্ষে অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না।
অলিভ দ্বিধা করলেন, হুঁ, তাই আমার ধারণা ছিল, সম্মেলনের আলোচনা নিয়ে তিনি একাগ্র হয়ে থাকবেন।
–হয়তো তাই, তবু ধরে নেওয়া যেতে পারে সেদিনের আলোচ্য বিষয়ের তেমন কোনো গুরুত্ব ছিলো না দেখে, তিনি সেদিনের জন্য অবসর নিয়েছিলেন। তবুও এটা আপনার স্বামীর উপযুক্ত কাজ বলে মনে হচ্ছে না।