-ও! দেখুন মিসেস বেটারটন আমাদের যাত্রা এখানেই শেষ হলো। মানে–একপ্রস্থ যাত্রা।
শেষ হলো? মানে?
–হ্যাঁ। ওরা এবার ওই দেহগুলোকে আমাদের প্লেনে ঠিকঠাক করে বসিয়ে দেবে। তারপর এই বিমানচালক কী সব কলকাঠি নেড়ে দেবে আর আমরা যখন এই মালগাড়িতে চেপে অনেকদূর এগিয়ে যাবো, দেখবো দূর আকাশে আগুনের লেলিহান শিখা। যেন একটা প্লেন দুর্ঘটনায় পড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে–তার কেউ বাঁচেনি।
–কিন্তু কেন? কী সাংঘাতিক কথা!
–কিন্তু–এবার ডাঃ ব্যারন তাকে বললেন, আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমরা কোথায় যাচ্ছি?
মিসেস বেকার কাছে এসে আগ বাড়িয়ে বললেন, জানেন বৈকি। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি–এটা হয়তো উনি আশা করেননি।
হিলারী এবার ঘুরে ঘুরে সবাইকে দেখে বললো, আমরা সবাই সেখানে যাচ্ছি?
পিটার্স বললো, আমরা সবাই সহযাত্রী যে। এরিকসন সোৎসাহে সমর্থন করলো, হ্যাঁ আমরা সব্বাই এক পথের পথিক।
.
০৯.
বিমানচালক এগিয়ে এসে বললো, আপনারা এবার এগোন, দেরি করবেন না, অনেক কাজ এখনও বাকি, তাছাড়া আমাদের নির্দিষ্ট সময়ও পার হয়ে গেছে।
মুহূর্তের জন্য চমকে এক পা পিছিয়ে এল হিলারী। ভয়ে, উত্তেজনায় একটা হাত আপনা থেকেই তার গলার কাছে চলে এলো। সবাই সেই গাড়িতে উঠলো। হিলারী একটা লম্বা বেঞ্চে বসেছে, একপাশে পিটার্স, অন্যপাশে মিসেস বেকার। আমেরিকান মহিলার দিকে ফিরে হিলারী বললো, তাহলে–আপনি-মানে আপনাকে যোগাযোগকারী অফিসার বলেই ডাকবো। কী বলুন, মিসেস বেকার?
–এক্কেবারে ঠিক জিনিষটি আপনি ধরে ফেলেছেন। আর নিজের মুখে বলা ঠিক নয়, তবুও বলছি এ কাজে আমি বেশ পটু। একজন আমেরিকান মহিলাকে, ঘুরে ঘুরে বেড়াতে দেখলে কারো সন্দেহ হবে না।
সহসা এদের পরিকল্পনার চাতুরী ধরে ফেললো হিলারী। বিড়বিড় করে বললো, আর এরা? এরা নিজের নিজের যা পরিচয় দিয়েছেন সত্যিই কি এঁরা তাই?
নিশ্চয়ই, ডাঃ ব্যারন একজন রোগজীবাণুবিদ বলে আমি জানি। মিঃ এরিকসন একজন প্রতিভাবান তরুণ পদার্থবিজ্ঞানী, মিঃ পিটার্স একজন ফলিত রসায়নের গবেষক, মিস নীডহেইস না উনি সন্ন্যাসিনী নন, উনি একজন স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞ। আর আমি-আপনি ঠিকই বলেছেন, কেবল যোগাযোগকারী অফিসার। খানিক হেসে বললেন, বেচারা হেদারিংটন, একটুও সুযোগ পেলো না।
মিস হেদারিংটন–তিনি কি
মিসেস বেকার বললেন, ও আপনাকে অনুসরণ করছিলো। ক্যাসাব্লাঙ্কা থেকেই ও আগের লোকের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেয়।
আপনি যখন ম্যারাকেশে পৌঁছবেন। দারুণ মজার ব্যাপার, তাই না? আর দেখুন দেখুন। ওই যে আমাদের প্লেনটা যাচ্ছে।
মরুভূমির মধ্য দিয়ে তাদের গাড়িটা ছুটে চলছিলো। হিলারী ঘাড় ফিরিয়ে জানালা দিয়ে তাকালো। পেছনের আকাশে অনেকখানি যেন দাউদাউ করে জ্বলছে। বিস্ফোরণের মতো একটা আওয়াজও তার কানে এলো–অনেক দূর থেকে। পিটার্স হো হো করে হেসে গড়িয়ে পড়লো। বললো–ম্যারাকেশগামী একটা প্লেন দুর্ঘটনায় ছজন যাত্রী নিহত হয়েছেন।
হিলারী শিউরে উঠে বললো, উঃ! কী ভয়ঙ্কর!
-কোনটা–অজানার পথে পা বাড়ানো? পিটার্সই বললো। এখন তাকে বেশ গম্ভীর মনে হচ্ছে। হ্যাঁ, খুবই ভয়ঙ্কর, কিন্তু এটাই একমাত্র পথ। অতীতকে ছেড়ে ভবিষ্যতের পথে আমরা পা বাড়াচ্ছি। সহসা দারুণ আগ্রহে তার চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠলো। যত কিছু পুরোনো, খারাপ জিনিষ আমাদের ত্যাগ করতেই হবে। দুর্নীতিপরায়ণ সরকার আর যুদ্ধবাজদের শেষ করতে হবে। নতুন জগতে প্রবেশ করতে হবে আমাদের–সে জগৎ বিজ্ঞানের জগৎ, যা সব কিছু মালিনা থেকে মুক্ত।
একটা লম্বা শ্বাস টানলো হিলারী। আমার স্বামীও ঠিক এই ধরনের কথা বলতেন, ইচ্ছে করেই সে কথাটা বললো।
-আপনার স্বামী? তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো পিটার্স। আপনার স্বামী কি টম বেটারটন? হিলারী সম্মতি জানালো।
-আচ্ছা!–তিনি তত বিরাট লোক। শূন্যশক্তি পরমাণু বিভাজন–এ যুগের এক চাঞ্চল্যকর আবিষ্কার-হ্যাঁ, অজস্র প্রণাম জানাই তাঁকে। বৃদ্ধ ম্যানহেইমের সঙ্গে কাজ করতেন তাই না?
-হ্যাঁ।
–আমি যে শুনেছিলাম উনি ম্যানহেইমের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন কিন্তু আপনি নিশ্চয়
–আমি তার দ্বিতীয় স্ত্রী, লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো হিলারী। সে-মানে-ওর স্ত্রী এলসা আমেরিকাতেই মারা যায়।
-হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে। এরপরই উনি কাজকর্ম চালিয়ে যাবার জন্য ব্রিটেনে চলে আসেন। তারপরই হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়ে ফাঁপরে ফেলে দেন। হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলো, প্যারিসের এক সম্মেলন থেকে হঠাৎ নিরুদ্দেশ, ওঃ! যাই বলুন, এদের ব্যবস্থাপত্তর কিছু বেশ সুষ্ঠু স্বীকার করতেই হবে।
হিলারীও স্বীকার করলো, এদের সংস্থার নিখুঁত কাজের কথা ভেবে বুকের মধ্যেটা একেবারে ঠান্ডায় হিম হয়ে উঠলো। যতকিছু পরিকল্পনা, সঙ্কেতা, চিহ্ন রেখে যাওয়া, যা কিছু সে শিখেছে, সবকিছু একেবারে অকেজো মনে হলো, কারণ এখন আর খুঁজে পাবার মতো কোনো চিহ্নই ওরা পাবে না। সমস্ত ব্যবস্থাটা এমনই নিখুঁত যে, শেষপর্যন্ত দেখা গেল, ওই প্লেনের প্রতিটি যাত্রীই অজানা ঠিকানার যাত্রী, যে পথে টমাস বেটারটন অনেক আগেই পাড়ি দিয়েছে। ওই পোড়া প্লেনটা ছাড়া কোনো চিহ্নই পড়ে থাকবে না। প্লেনের মধ্যে কটা ঝলসানো মৃতদেহও থাকবে। জেসপ আর তার লোকজনেরা কি এটা বুঝতে পারবে যে–ঐ ঝলসানো মৃতদেহগুলোর মধ্যে হিলারী নেই? যথেষ্ট সন্দেহ আছে। দুর্ঘটনাটা এক চতুরভাবে–এত বিশ্বাসযোগ্য ভাবে ঘটানো হয়েছে