ছয়জন লোক মাত্র কঘন্টার জন্য একসঙ্গে চলেছে, ভাবছিলো হিলারী। ছজন বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চলেছে।
চোখ বন্ধ করে হিলারী সহযাত্রীদের কথা ভুলে গিয়ে গতকাল সারারাত ধরে তাকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাই নিয়ে চিন্তা করেছে সে–আজও সেই ধাঁধার উত্তর খুঁজতে লাগলো। তাকে ইংল্যান্ড ফিরে যেতে হবে। পাগল! নাকি সেই কোথাও ভুল করলো। ওরা হয়তো তাকে বিশ্বাস করেনি! দুশ্চিন্তায় নড়েচড়ে বসলো হিলারী। মনে মনে বললো, মরুকগে, যা করছি তার বেশি আর কিছু করতে পারব না আমি। তাতে যদি ব্যর্থ হয়ে থাকি হয়েছি।
সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুতের মত আর একটা চিন্তা মাথায় খেলে গেলো। মরক্কোয় যে হিলারীর ওপর নজর রাখা হয়েছে এটা খুবই স্বাভাবিক বলে বিশ্বাস করেছে লরেল। তবে কি পুলিসের সন্দেহ মিথ্যে এটাই প্রমাণ করার জন্যই তাকে ইংল্যান্ড ফেরত পাঠাতে চায় ওরা! মিসেস বেটারটন হঠাৎই ইংল্যান্ড ফিরে গেলে তার ওপর থেকে সব সন্দেহ দূর হয়ে যাবে-তাকে একজন সত্যিকারের ভ্রমণার্থী বলেই মেনে নেবে ওরা।
এয়ার ফ্রান্সের বিমানে প্যারিস হয়ে ইংল্যান্ড ফিরতে হবে–আর সম্ভবতঃ প্যারিসেই টম বেটারটন উধাও হয়েছিল। এখান থেকে কাউকে উধাও করে দেওয়া নিশ্চয়ই খুব সহজ। টম বেটারটন নিশ্চয়ই কখনোই প্যারিস ত্যাগ করেননি। এসব আজগুবি চিন্তায় মাথা ভরে এলো হিলারীর। কখন যেন গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো সে, হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতে মনে হলো প্লেনটা দ্রুতগতিতে নিচে নামছে আর চক্কর দিচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো এখনও তো পৌঁছবার সময় হয়নি। তাছাড়া, বাইরে তাকিয়ে নিচে কোনো বিমানবন্দরের চিহ্ন চোখে পড়ল না।
মুহূর্তের জন্য অজানা ভয় তাকে জড়িয়ে ধরলো। মিসেস কেলভিন বেকার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে হিলারী বললো, আমরা পৌঁছে গেছি বোধহয়।
প্লেনটা নিচে নেমে চক্কর দিচ্ছে–জনহীন মরুভূমির মতো জায়গা। অনেক দূর পর্যন্ত কোনো গ্রাম বা বাড়ির চিহ্নমাত্র পড়লো না। ইঞ্জিনের কোনো গোলমাল হলো না তো! ভাবছিলো হিলারী। সামনের দরজা দিয়ে কালো চামড়ার এক যুবক নিঃসন্দেহে প্লেনের চালক, বেরিলয়ে এসে বললো, দয়া করে আপনারা নেমে পড়ুন। পেছনের দরজা খুলে একটা সিঁড়ি নামিয়ে দিয়ে সে সকলের নেমে যাওয়ার অপেক্ষায় রইলো, চালক নিজেও নেমে এসে ফরাসী ভাষায় বললো : আপনারা সবাই এখানে আছেন?! আপনাদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে এখানে, সেজন্য মাফ করবেন।-ওই তো এসে গেছে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই দেখলো, দিগন্তের গায়ে একটা বিন্দু ক্রমশঃ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। হিলারী হতচকিত ভাবে জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু এখানে আমাদের নামার কারণ কী? এতক্ষণ এখানে আটকে থাকতে হবে আমাদের?
ফরাসি ভদ্রলোক বললো, মনে হচ্ছে একটা মালগাড়ি আসছে এদিকে, আমাদের কি ওতে চেপে যেতে হবে?
-ইঞ্জিন খারাপ হয়েছে নাকি? হিলারী জিজ্ঞেস করলো।
অ্যান্ড্রু পিটার্স সকৌতুকে বললো, মোটেই না, ইঞ্জিন তো বেশ ভালোই চলছিলো। যাইহোক, মনে হচ্ছে এরা আমাদের যাত্রার এইরকম ব্যবস্থা করেছে।
হিলারী হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। মিসেস কেলভিন বেকার গজগজ করতে লাগলেন, উঃ কী ঠান্ডা! এখানে দাঁড়িয়ে থাকা যায়!
বিমান চালক মনে মনে অভিশাপ দিচ্ছিলো। হিলারীর মনে হলো সে যেন বলছে রোজ রোজ এই দেরি–সহ্য হয় না আর!
মালগাড়িটা দূরন্ত গতিতে এসে থামলো। দেহাতী চালকের সাথে বিমানচালকের তর্কাতর্কি শুরু হয়ে গেলো। ওদের মাঝে মিসেস বেকারকে মধ্যস্থতা করতে দেখে হিলারী আশ্চর্য হলো। ওদের প্রায় ধমক দিয়ে ফরাসিতে বলছেন, সময় নষ্ট কোরো না। তর্ক করে লাভ নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা এখান থেকে বেরিলয়ে যেতে চাই।
মালগাড়ির চালক হতাশভঙ্গি করে গাড়ির কাছে ফিরে এলো। পেছনের দরজাটা খুলে ফেলে, বিমানচালক, এরিকসন আর পিটার্সের সাহায্যে একটা বিরাট বাক্স বাইরে বের করে আনলো। দেখে মনে হলো দারুণ ভারি। দেহাতী লোকটা যখন বাক্সের ডালা খুলছে, কেলভিন বেকার হিলারীর একটা হাত আঁকড়ে ধরলেন। বললেন, আমি দেখতে পারবো না ভাই। দৃশ্যটা নিশ্চয়ই খুব সুখকর হবে না।
হিলারীকে ধরে তিনি মালগাড়ির উল্টোদিকে চলে গেলেন। সেই ফরাসি ভদ্রলোক আর পিটার্সও তাদের সঙ্গে এলো। ফরাসি লোকটি তার দেশীয় ভাষায় বলছিলেন, এতে কী এমন আছে, যা নিয়ে ওরা এত কসরৎ করছে?
মিসেস বেকার বললেন, আপনি তো ডাঃ ব্যারন, তাই না? আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, বলে মিসেস বেকার আপ্যায়নের ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলেন।
হিলারী জিজ্ঞেস করলো, মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। ওই বাক্সে কী আছে? ওটা না দেখাই ভালো কেন?
অ্যান্ড্রু পিটার্স বললো, ওতে কী আছে আমি বলতে পারি, প্লেনের চালক আমাকে বলেছে মনোরম কিছু নয়, তবে খুব প্রয়োজনীয় জিনিষ বোধহয়। একটু হেসে শান্ত গলায় বললো, ওর মধ্যে কটা মানুষের দেহ আছে।
–মানুষের দেহ! অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো হিলারী। না না, এখনও ওদের মারা হয়নি। সান্ত্বনার হাসি হাসলো সে, অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই ওদের আনা হয়েছিলোগবেষণা, মানে শারীরবিদ্যা গবেষণার জন্য।
হিলারী হা করে তাকিয়ে রইল–আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।