-ম্যারাকেশ আমার ঘোরা, মিস হেদারিংটন বললেন, কিন্তু মিসেস বেকার এই প্রস্তাবে লাফিয়ে উঠলেন। বেকার বললেন, আমি বরং একবার অফিসঘর ঘুরে দেখি আপনার সঙ্গে যাওয়ার কী বন্দোবস্ত করা যায়।
মিস হেদারিংটন উল কাটার ব্যাগ গুছিয়ে বেরিলয়ে গেলেন। হিলারী তার ঘড়ির টাইম দেখছিলেন–নৈশাহারে যাবার আগে সে আর পোশাক পাল্টাবেন না। সে ডিভানে গা এলিয়ে ভবিষ্যৎ দিনগুলোর কথা ভাবছে।
গতকাল তার মনে হয়েছিল যে কাজে সে নিজেকে উৎসর্গ করেছে তার সবটাই মিথ্যে। কিন্তু এখন তা মনে হচ্ছে না। এখন সে আসল অভিযানের জন্য পা বাড়াতে প্রস্তুত। তাকে সাবধান হতে হবে। তাকে পুরোপুরি অলিভ বেটারটনে রূপান্তরিত হতে হবে।
না, কোনোরকম ভুল করবো না আমি, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে শপথ নিলো হিলারী।
মরক্কোর এক নির্জন, আধো অন্ধকার ঘরে সম্পূর্ণ একা বসে থাকা কী অদ্ভুত! তার পাশেই একটা পেতলের প্রদীপ। আচ্ছা–সে যদি ওই পেতলের প্রদীপটা হাতে নিয়ে ঘষে তার থেকে সেই জীনটা বেরিলয়ে আসবে না তো! চিন্তাটা মাথায় আসতেই বুকের মধ্যে গুরগুর করে উঠলো আর তখনই প্রদীপের পেছন থেকে একটা বলিরেখা চিহ্নিত ছাগলদাড়িওলা মুখ দেখা দিল, মিঃ অ্যারিস্টাইডস! এগিয়ে এসে বসার অনুমতি চাইলেন। হিলারী সম্মতি জানালো।
সিগারেটের কেস থেকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিলেন, হিলারী নিলো, নিজেও একটা ধরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এ দেশটা আপনার ভালো লাগছে তো, মাদাম?
-খুব অল্প সময় এসেছি আমি, তবুও কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে।
–বা! পুরোনো শহর দেখেছেন? ভালো লাগেনি?
–অপূর্ব-অপূর্ব লেগেছে।
-হ্যাঁ, সত্যিই অপূর্ব। অতীতের অনেক কিছুই ওখানে রয়েছে। ফেজ-এর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার লন্ডনের গ্রেট ওয়েস্ট রোডের কথা মনে পড়ে যায়। সেই রাস্তার দুধারে বড় বড় কারখানা বড় বড় বাড়িতে ঝলমলে আলো জ্বলছে। কিছু লুকোনো নেই সেখানে, কোনোকিছুই রহস্যময় নয়।
হিলারী বললো, আপনি বলতে চাইছেন, এই বৈসাদৃশ্যটাই আপনাকে আকৃষ্ট করে?
মিঃ অ্যারিস্টাইডস ঘাড় নাড়লেন, হ্যাঁ, ওখানে সবকিছু উন্মুক্ত আর ফেজ-এর পুরানো রাস্তায় কোনো কিছুই প্রকাশ্য নয়। সবকিছু লুকোনো, অন্ধকার…, কিন্তু কিন্তু সবকিছুই আগের মতো চলছে। সেই নৃশংসতা, সেই নির্মম অত্যাচার, সেই ক্ষমতার আসনে বসার লোভ, সেই দরকষাকষি, ঝগড়া বিবাদ।
–আপনি বলছেন, সর্বকালে সর্বদেশে মানবপ্রকৃতি একই রকম?
-হ্যাঁ, ঠিক তাই। সবদেশে এই হয়। আগে যেমন হতো, এখনও ঠিক তাই–দুটো জিনিষ নিয়ে শাসনকার্য চলে। এক–নৃশংসতা এবং দুই-মহানুভবতা। একটু থেমে তিনি বললেন, আমি শুনেছি মাদাম, কদিন আগে আপনি ক্যাসাব্লাঙ্কায় এক ভয়ঙ্কর প্লেন দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন?
-হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন।
–আপনাকে দেখে আমার ভীষণ হিংসে হচ্ছে। অবাক চোখে তাকালো হিলারী। মিঃ অ্যারিস্টাইডস আবার বললেন, হ্যাঁ আপনাকে হিংসা করা উচিত। কারণ আমি একটা অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। মৃত্যুর এত কাছাকাছি পৌঁছবার এমন অভিজ্ঞতা পেতে ভীষণ ইচ্ছে করে আমার। আচ্ছা, সেই থেকে আপনার চিন্তাভাবনার কোনো পরিবর্তন হয়নি, মাদাম?
হয়েছে, তবে সেটা খুব সুখকর নয়, হিলারী বললো। মাথায় খুব জোর চোট লেগেছিলো আমার। সেই থেকে সাংঘাতিক মাথার যন্ত্রণা শুরু হলো, আর স্মরণশক্তিও কেমন যেন গুলিয়ে গেলো।
মিঃ অ্যারিস্টাইডস হাত নেড়ে বললেন, এগুলো তো সাধারণ কথা কিন্তু আপনার আত্মা যে একটা ভয়ঙ্কর রোমাঞ্চকর অভিযান সেরে এসেছে, এটা তো স্বীকার করবেন?
তা সত্যি। সত্যিই এক ভয়ঙ্কর রোমাঞ্চকর অভিযান সেরে এসেছি আমি। সেই ঘুমের ওষুধের মোড়ক আর জলের গ্লাসের কথা হিলারীর চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
-কত কী-ই হলো, কিন্তু এ অভিজ্ঞতা আমার কপালে জুটলো না। মিঃ অ্যারিস্টাইডস বললেন।
তিনি উঠে পড়লেন। আনত অভিবাদন করে, আমার সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানাচ্ছি, মাদাম, বলে ঘর থেকে বেরিলয়ে গেলেন।
.
০৮.
সব বিমানবন্দরগুলোর মধ্যেই কী অদ্ভুত সাদৃশ্য, ভাবছিলো হিলারী। প্রত্যেকটাকে ঘিরেই কেমন যেন অদ্ভুত এক অজানার হাতছানি। সবগুলোই শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে, যেখানে গেলে অদ্ভুত একটা কথা বারবার মনে হয়-মনে হয় যেন সমাজ, রাষ্ট্র থেকে বহুদূরে এক শূন্যতার মাঝে এসে পড়েছি।
বিমানবন্দরের বিশ্রামঘরে প্রায় আধঘণ্টা আগে এসেছে ওরা। মিসেস কেলভিন বেকার শেষপর্যন্ত হিলারীর সঙ্গে ম্যারাকেশ যাওয়া ঠিক করলেন। এখানে এসে কেলভিন বেকার আরো দুজন ভদ্রলোকের সাথে বন্ধুত্ব করেছেন। একজন আমেরিকান অন্যজন ডেনিস বা নরওয়ের নোক।
মিসেস বেকার হিলারীকে দেখে তাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন, আমার বন্ধু, ইনি মিসেস বেটারটন।
একজন বললো, আমার নাম ‘অ্যান্ড্রু পিটার্স, আরেকজন বললো আমার নাম ‘টরকুইল এরিকসন।
তাহলে আমাদের সকলের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেলো, মিসেস বেকার বললেন, আপনারাও ম্যারাকেশ যাচ্ছেন? আমার বন্ধুও এই প্রথম ওখানে যাচ্ছেন
হঠাৎ ঘোষণা শোনা গেল প্লেন ওঠার সময় হয়ে এসেছে। মোট ছজন যাত্রী। হিলারী, মিসেস বেকার, পিটার্স আর এরিকসন ছাড়া একজন লম্বা মতো রোগাটে ফরাসি ভদ্রলোক, আর একজন কদাকার সন্ন্যাসিনী।
বেশ সুন্দর ঝকঝকে সকাল, প্লেন ওড়ার আদর্শ আবহাওয়া। নিজের আসনে গা এলিয়ে দিয়ে আধবোজা চোখে হিলারী তার সহযাত্রীদের লক্ষ্য করছিলো, আর নিজের মনের দুশ্চিন্তা দূর করছিলো। মিসেস কেলভিন বেকার মাঝের চলাচলের পথের ওপাশে একটা আসনে রয়েছেন। ঠিক সামনে বসেছেন এরিকসন এবং তার পেছনে বসেছেন কদাকার সেই সন্ন্যাসিনী।