লরেল মাথা নাড়লো, তারপর যেন একটু ভৎর্সনার সুরে বললো, ট্রেনে আপনাকে দেখে কেমন অদ্ভুত মনে হয়েছিলো আমার, সারাক্ষণ শুধু আবহাওয়ার কথাই বলে গেলেন।
–আবহাওয়া! চোখ বড়বড় করে হিলারী তার দিকে তাকিয়ে রইলো।
ট্রেনে এই লোকটা আবহাওয়া সম্পর্কে কী বলেছিলো যেন? ঠান্ডা? কুয়াশা? না–বরফ?
বরফ। হা-তুষার। মৃত্যুকালে অলিভ বেটারটনও ফিসফিস করে এই কথাটাই বলেছিলো-বারবার। গুনগুন করে সেই ছোট্ট ছড়াটাই সে মনে করার চেষ্টা করলোকী যেন ছড়াটা…? হ্যাঁ
তুষার, শুধু তুষার শুভ্র সুন্দর
তুষার-সে মৃত্যুগহ্বর!
বারবার আউড়ে ছড়াটা মনে গেঁথে নিল।
-হা,–আবহাওয়া–আপনার প্রতি যেমন নির্দেশ ছিলো, সেইমতো উত্তর দেননি কেন? লরেল এবার সরাসরি ধমক দিলো।
–আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন না–আমি ভীষণ অসুস্থ হয়েছিলাম। প্লেন দুর্ঘটনায় সাংঘাতিক আহত হই আমি। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। ফলে আমার স্মৃতিশক্তি প্রায় লোপ পায়। অনেকদিন আগের কথাবার্তা সব মনে পড়ে, কিন্তু তারপর–তারপর সব যেন ফাঁকা-বিরাট শূন্যতা। আপনি হয়তো বুঝতে পারবেন না কী ভয়ঙ্কর সেই অবস্থা।
-হঁ, লরেল বললো, প্লেন দুর্ঘটনাটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। একেবারে সাদামাটা ব্যবসায়ীর গলা–সহানুভূতির চিহ্নমাত্র নেই। এর পরেও–ভ্রমণসূচী অনুযায়ী চলার মতো মনের জোর আর সাহস আপনার থাকবে কিনা সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
–অবশ্যই আমি যাবো–চুপ করে বসে থাকতে পারি না আমি। আমার স্বামী-বলতে বলতে কান্নায় তার গলা বুজে এলো।
লরেল শৃগালের মতো ধূর্ত হাসি হেসে বললো–আপনার স্বামীহা, যতদূর জানি, আপনার জন্য তিনি অধীর অপেক্ষায় রয়েছেন।
হিলারী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো, আপনি বুঝতে পারবেন না, ও চলে আসার পর এই কটা মাস আমার কীভাবে কেটেছে
–আপনি এ ব্যাপারে কতটুকু জানেন না জানেন, সে সম্পর্কে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কি সঠিক কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে বলে আপনার মনে হয়?
হাতদুটো দুপাশে ছড়িয়ে অদ্ভুত ভঙ্গি করলো হিলারী, তা আমি কি করে জানবো…? তবে মনে হয়, ওরা বেশ সন্তুষ্ট।
–তার মানেই, হঠাৎ সে চুপ করে গেলো।
-আমার মনে হয় এটার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে, আস্তে আস্তে বলতে লাগলো হিলারী, ওরা হয়তো আমার পিছু নিয়ে এখানে এসেছে। স্পষ্ট করে কাউকে চিনতে পারিনি বটে, কিন্তু ইংল্যান্ড ছাড়ার পর থেকেই আমার যেন মনে হয়েছে, কেউ আমাকে অনুসরণ করছে।
-খুবই স্বাভাবিক, আমরাও এটাই আশা করেছিলাম, লরেল বললো।
–আমার মনে হয়েছে আপনাদের সাবধান করে দেওয়া দরকার।
মিসেস বেটারটন, আমরা কচি খোকা নই, আমরা যা করি বুঝে শুনেই করি।
হিলারী বললো, আমি দুঃখিত। আমি খুব বোকা, তাই না?
–আমাদের কথামতো যদি চলেন তাহলে আপনি বোকা হলেও কিছু যায় আসে না।
আপনার স্বামী চলে যাবার পর থেকেই যে ইংল্যান্ডে আপনার গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখা হয়েছে, এ বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই, তাছাড়া–খবরটা আপনার কাছেই এসেছিল, তাই না?
-হ্যাঁ।
লরেল এবার সরাসরি কাজের কথা বললো, আপনার প্রতি যে নির্দেশ আছে তা আপনাকে জানাচ্ছি। আগামী পরশু এখান থেকে আপনি ম্যারাকেশের পথে রওয়ানা হবেন, সেইমত সব ব্যবস্থাপত্র করা আছে।
-বেশ।
ম্যারাকেশ পৌঁছাবার পরদিন ইংল্যান্ড থেকে একটা তারবার্তা পাবেন। তাতে কী-লেখা থাকবে তা আমি জানি না, কিন্তু তক্ষুনি ইংল্যান্ড ফিরে যাবার ব্যবস্থা করার মতো যথেষ্ট যুক্তি তাতে থাকবে।
আমাকে আবার ইংল্যান্ড ফিরে যেতে হবে!
–আহা–আগে শুনুন। পরদিন ক্যাসাব্লাঙ্কা থেকে ইংল্যান্ডের টিকিট কাটবেন।
–যদি টিকিট না পাই–ধরুন সব আসনই ভর্তি থাকে?
-না–সব আসন ভর্তি থাকবে না। তার জন্যও সব ব্যবস্থা করা থাকবে, এখন কী কী আপনাকে করতে হবে-বুঝলেন তো?
বুঝেছি।
তাহলে এবার দয়া করে আপনার পথপ্রদর্শক যেখানে অপেক্ষা করছে সেখানে ফিরে যান। অনেকক্ষণ হলো আপনি প্রসাধন ঘরে ঢুকেছেন। হ্যাঁ ভালো কথা–জামা প্যালেসের যে একজন আমেরিকান এবং একজন ইংরেজ মহিলার সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছে তাদের একজনকে যদি আপনার সাথে ম্যারাকেশ যেতে রাজি করাতে পারেন, খুব ভালো হয়। আচ্ছা বিদায়, মাদাম।
–বিদায়, মঁসিয়ে।
-আপনার সঙ্গে আর আমার দেখা হবার সম্ভাবনা নেই-লরেল বললো।
হিলারী এবার প্রসাধন ঘরে ফিরে এলো। দরজা ঠেলতেই দরজা খুলে গেলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে প্রথপ্রদর্শকের সঙ্গে মিলিত হলো।
পরিকল্পনা মতো অভিযানের পথে এগিয়ে চললো হিলারী।
মিস হেদারিংটন বললেন, তাহলে কাল আপনি ম্যারাকেশ চললেন? ফেজ-এ বেশিদিন থাকলেন না, তাই না? তার চেয়ে প্রথমে ম্যারাকেশ হয়ে ক্যাসাব্লাঙ্কা ফেরার পথে ফেজ ঘুরে গেলেই পারতেন।
–তা করলেই ভালো হতো, হিলারী বললো, কিন্তু টিকিট পাওয়া মুশকিল। যা ভিড় এখানে।
–ইংরেজদের ভিড় নয় কিন্তু, মিস হেদারিংটন দুঃখের সঙ্গে বললো। নিজের দেশের লোক দেখতে পাওয়া যায় না। চারিদিকে দেখুন, কেবল ফরাসিদের ভিড়।
মুচকি হাসলেন হিলারী, মরক্কো যে একসময় ফরাসি উপনিবেশ ছিলো একথা মিস হেদারিংটন বোধহয় ভুলেই গেছেন।
এবার হিলারী বললেন, আপনারা যদি আমার সঙ্গে ম্যারাকেশ যান খুব খুশি হবো আমি। এখানে আপনাদের সঙ্গে আলাপ করে যথেষ্ট আনন্দ পেয়েছি, সত্যি একা একা বেড়ানো খুবই বিরক্তিকর।