যাক, বলুন কেমন বেড়াচ্ছেন? পুরোনো শহর দেখে ফিরলেন মনে হচ্ছে।
-না–কই আর গেলাম, কিছুই দেখা হয়নি এখনও, হেসে হিলারী বললো। একটা রোদ্দুর পুইয়ে এলাম শুধু।
-ও, হা হা-সবেমাত্র হাসপাতাল থেকে বেরিলয়েছেন আপনি। ভুলেই গিয়েছিলাম। যাক,
আমরা দুজন একসঙ্গে বেরোবোখন। বেরোবার মতো মনের অবস্থা না থাকলেও বেকারের উৎসাহকে তারিফ না করে পারলো না।
মিসেস বেকার আবার বললেন, ক্যাসাব্লাঙ্কার সেই মিস হেদারিংটনের কথা মনে আছে? উনি ট্রেনে করে এখানে আসবেন।
রাতে খাবার ঘরে ঢুকেই হিলারী দেখলেন দেওয়ালের ধারে একটা টেবিলে মিস হেদারিংটন খাচ্ছেন। আহারের পর তিন মহিলা একসাথে বসে কফি খেলেন।
মিসেস কেলভিন বেকার পরের দিন কোথায় কোথায় বেড়াতে যাবেন তার পরিকল্পনা শুরু করে দিলেন। এবার আর পুরোনো শহরে যাবার ইচ্ছে নেই। গতবারই সব খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছি। খুব মজার জায়গা। যেন একটা গোলকধাঁধা। আমার সঙ্গে যদি একজন পথপ্রদর্শক না থাকতো, রাস্তা চিনে হোটেলে ফিরতে পারতাম না। আমাকে যে লোকটা নিয়ে গিয়েছিলো সে খুব ভালো লোক। সে একটা চায়ের দোকানে নিয়ে গেলো–শহরের ঠিক মাথার ওপরে পাহাড়ের দিকটায় চমৎকার জায়গাটা।
.
০৭.
মিসেস বেকার, মিস হেদারিংটনকে নিয়ে ফেজ-এর পুরোনো শহর দেখতে গেলেন আর হিলারীকে হোটেল থেকে একজন পথপ্রদর্শক ঠিক করে দিলো, হিলারী তাকে নিয়ে ফেজ শহর ঘুরতে বেরিলয়ে পড়লো।
চত্বর থেকে চত্বর আর বাগান পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত তারা ধনুকের খিলান যুক্ত এক বিশাল ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালো। পথপ্রদর্শক চাবি দিয়ে দরজা খুলে হিলারীকে ভেতরে যেতে ডাকলো।
যেন এক নতুন জগতে পা রাখলো হিলারী, তার চারপাশে এখন শুধু ফেজ শহরের টানা পাঁচিল। আঁকাবাঁকা সরু পথ, দুধারে উঁচু দেওয়াল। মাঝে মাঝে একটা দরজা, এক চিলতে উঠোন–সরু সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সবকিছু ভুলে গেলো হিলারী। তার গুপ্তচর বৃত্তির কথা, অতীত দিনের দুঃখ-যন্ত্রণা, এমনকি নিজেকেও সে যেন হারিয়ে ফেললো। তার মনে হচ্ছে সে যেন স্বপ্নপুরীতে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। একমাত্র তার পথপ্রদর্শকই এটা ওটা কেনার জন্য বিরক্ত করছিলো।
এই পাঁচিল ঘেরা শহরের কোথায় কোন দিকে চলেছে, উত্তর না দক্ষিণে, নাকি একই রাস্তায় বারবার ঘুরছে সে। অসীম ক্লান্তিতে পা দুটো যখন আর চলতে চাইছে না, ঠিক তখনই তার পথপ্রদর্শক বেড়ানোর শেষ অংশটুকু উপভোগ করার প্রস্তাব রাখলো। এবার আপনাকে একটা চমৎকার বাড়িতে নিয়ে যাবো। খুব সুন্দর বাড়ি। সব্বাই আমার চেনাজানা ওখানে। বসে বসে চা খাবেন, আর হরেকরকম সুন্দর সুন্দর জিনিষ দেখাবে ওরা।
হিলারীর বুঝতে অসুবিধে হলো না, মিসেস কেলভিন বেকার এই গলাকাটা দোকানটার কথাই বলেছিলেন। তবুও তার ইচ্ছে হলো, ওরা যা দেখতে চায় তা দেখাতে। মনে মনে হিলারী ঠিক করলো আগামীকাল আবার তিনি এখানে আসবেন। হিলারী লোকটার পেছন পেছন পথ বেয়ে উঠে এলো। জায়গাটা শহরের প্রাচীরের প্রায় বাইরে। অনেকখানি উঠে বাগানঘেরা একটা চমৎকার এদেশী ধাঁচের হাঁড়ির সামনে হাজির হলো। একটা বড়সড় ঘরের একটা কফির টেবিলে বসতে অনুরোধ করা হলো তাকে। ঘর থেকে বাইরের শহরটাকে মনোরম দেখায়। সেই পুদিনাপাতার গন্ধে ভরপুর চা এলো একসময়। তারপর নানাধরনের জিনিষ দেখানো হলো-কম্বল, পোশাক-পরিচ্ছদ, মুক্তো, আরও নানা জিনিষ। ভদ্রতার খাতিরে দু-একটা কমদামী জিনিষ কিনলো সে।
সব সারা হলে পথপ্রদর্শক বললো, একটা গাড়ির ব্যবস্থা করেছি, ঘণ্টাখানেক ঘুরে হোটেলে ফিরবো আমরা। একটু থেকে কী যেন আঁচ করে সে আবার বললো, তার আগে–এই মেয়েটি আপনাকে মহিলাদের প্রসাধন ঘরে নিয়ে যেতে পারে।
পাশেই একটা মেয়ে চা পরিবেশন করছিলো, হাসিমুখে এগিয়ে এলো। বললো, হা হা, মাদাম। আসুন আমার সঙ্গে। চমৎকার পরিচ্ছন্ন প্রসাধন ঘর আছে আমাদের।
মুচকি হেসে হিলারী মেয়েটিকে অনুসরণ করলো। প্রসাধন ঘরের উচ্চতা হাত দিলে ছোঁয়া যায়। তা হোক, বেশ পরিষ্কার। সর্বক্ষণ জল পড়ছে, দুর্গন্ধও নেই। হাতমুখ ধুয়ে নিজের রুমালে মুখ মুছে বেরোবার জন্য সে দরজার সামনে এলো। হঠাৎ তার মনে হলো, দরজাটা বাইরে থেকে কে যেন আটকে দিলো। প্রসাধন ঘরে তাকে আটকে রাখার কী কারণ থাকতে পারে। হঠাৎ তার চোখে পড়লো, ঘরের এককোণে আরেকটা দরজা রয়েছে। এগিয়ে গিয়ে দরজার হাতল ধরে টানতেই দরজাটা সহজেই খুলে গেলো।
দরজা দিয়ে বেরিলয়ে সে একটা অন্ধকার ঘরে এসে পড়লো, সামান্য আলো আসছে দেওয়ালের ওপর দিকের ছোট্ট ঘুলঘুলি দিয়ে। ঘরের একধারে বসে এক ফরাসি ভদ্রলোক সিগারেট টানছে, ভদ্রলোক আর কেউ নন, সেই ট্রেনে আলাপ–মঁসিয়ে হেনরি লরেল।
লরেল তাকে অভ্যর্থনা না জানিয়ে একটু মেকি গলায় শুধু বললো, শুভ সন্ধ্যা, মিসেস বেটারটন।
মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো হিলারী। সমস্ত ব্যাপারটা বুঝে নিজেকে সংযত করে নিল হিলারী। সাহসী মনটা বললো–যাও, এগিয়ে যাও। অলিভ যা করতে বলে তোমার মনে হয়, ঠিক তেমন অভিনয় করো। আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে উদ্বিগ্ন স্বরে সে জিজ্ঞেস করলো আমার জন্য কোনো খবর আছে? আপনি আমায় কোনো সাহায্য করতে পারেন?