-এরজন্য আর ভাবনা কী! খুব সোজা ব্যাপার। এখানে একজন বন্ধুর সঙ্গে ব্যবস্থা করে নিলেই হলো।
ইংল্যান্ড থেকে এখানে আপনার একটু হাওয়া বদল হবে, মাদাম, যেমন ঠান্ডা, তেমনি কুয়াশা-কী বিশ্রী আবহাওয়া আপনাদের ওখানে।
–যা বলেছেন-সত্যি চমৎকার হাওয়া বদল হয়ে এলো। ওরা সন্ধ্যে নাগাদ ফেজ-এ পৌঁছলো।
আপনার কোনো সাহায্যে লাগতে পারি, মাদাম?
স্টেশনে হৈ-হট্টগোল আর হুটোপাটির মধ্যে কেমন দিশাহারা হয়ে দাঁড়িয়েছিল হিলারী। কৃতজ্ঞ চোখে সদ্যপরিচিত বন্ধুটির দিকে তাকালো।
–আপনি তো জামা প্যালেসে উঠবেন তাই না? ঠিক আছে। ওটা কিন্তু এখান থেকে আট কিলোমিটার দূরে, জানেন তো?
–আট কিলোমিটার! হিলারী যেন আঁতকে উঠলো। হোটেলটা শহরের মধ্যে নয়?
যদি বলেন, একটা ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
খুব মহানুভব আপনি, কিন্তু…।
ফরাসি বন্ধুটি দ্রুত আরবিভাষায় কুলিদের কী সব যেন বললো আর মুহূর্তে হিলারী একটা ট্যাক্সিতে চড়ে বসলো। সে হিলারীকে একটা কার্ড দিয়ে বললো, আমার কার্ড, মাদাম, যদি কখনো আপনার কোনো উপকারে লাগতে পারি, আমাকে জানাবেন। আরও চারদিন আমি এখানে গ্র্যান্ড হোটেলে থাকবো।
হিলারী কার্ডটা একবার চোখের সামনে মেলে ধরলো, মসিয় হেনরি লরেল।
শহর ছাড়িয়ে, গ্রামের মধ্য দিয়ে একটা পাহাড়ের দিকে দ্রুতবেগে চলতে লাগলো ট্যাক্সিটা। ট্যাক্সিটা তাকে জামা প্যালেসের সামনে নামিয়ে দিলো। বিশাল তোরণের উঁচু খিলানের নিচ দিয়ে ভেতরে ঢুকে প্রাচ্যের হাতছানি দেখে মনটা খুশী খুশী হয়ে উঠলো হিলারীর। অনেকগুলো ঘর পেরিয়ে তাকে একটা চত্বরে নিয়ে এলো একজন কুলি এবং সেখান থেকে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে চমৎকার একটা শোবার ঘরে। কুলিটি জানালো সাড়ে সাতটার সময় নৈশাহার। বাক্সপ্যাটরা খুলে, হাতমুখ পরিষ্কার করে, চুলটা একটু আঁচড়ে সে নিচে খাবার ঘরে এলো। চমৎকার খাবার। খেতে খেতে হিলারী অনেককেই যেতে আসতে দেখলো। নিজেকে এত ক্লান্ত বোধ হচ্ছিল যে খাবার ঘরের লোকগুলো সম্পর্কে বিচার-বিবেচনা করার কোনো চেষ্টা করলো না সে। নৈশাহার শেষ করে চত্বরে এসে কফি নিয়ে বসলো হিলারী। একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব, কিন্তু বাতাসে শীতের কামড় নেই। চমৎকার ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। কফি শেষ করে সে ঘরে গিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো।
পরদিন সকালে, চত্বরে একটা বিরাট ছাতার তলায় বসে হিলারী ভাবছিলোআগাগোড়া সমস্ত ঘটনাগুলোই কেমন অবান্তর। এখানে একজন মৃতা মহিলার নাম নিয়ে তার ভূমিকায় সে অভিনয় করছে। বেচারী অলিভ বেটারটনের জন্য খুবই দুঃখ হচ্ছে হিলারীর।
এখানেও কোনো অপরাধের গন্ধ বা কার্যকরী কোনো সূত্র পেলো না হিলারী। নিচের বাগানের দিকে তাকালো, দেখলো চমৎকার শান্ত বাগানটা। একজন সুন্দরী সুইডিস মহিলাও বাগানে বসেছিলেন। তার স্বামী না অন্য কেউ একজন ভদ্রলোক এসে মেয়েটির পাশে বসলো এবং কিছু একটা বিষয় নিয়ে তর্ক জুড়ে দিল। ভদ্রলোক প্রতিবাদ করলো আবার ক্ষমাও চাইলো।
হিলারী মার্টিনী নিয়ে আসতে বললো পরিচারকটিকে। তারপর পরিচারকটির সাথে হিলারীর অনেকক্ষণ গল্পগুজব হলো। সবাই খেতে চলে গেছে কিন্তু হিলারী বাগানে বসেছিল। হঠাৎ পানশালা থেকে একজন ফরাসি যুবক বেরিলয়ে এলো। হিলারীর পাশ দিয়ে যাবার সময় একবার সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে একটা ফরাসি ছবির গান গাইতে গাইতে নামলো
লরেলের গোলাপবাগের ছায়াতলে।
মিষ্টি ছায়া মধুর লাগে।
গানের কথাগুলো হিলারীর মাথায় আস্তে আস্তে যেন গেঁথে বসতে লাগলো। লরেলের গোলাপবাগের ছায়াতলে। লরেল। ট্রেনে আলাপ হয়েছিলো ঐ ফরাসি ছেলেটির নামও লরেল। এরসঙ্গে কি তার কোনো যোগসূত্র আছে? ব্যাগ খুলে কার্ডটা বের করে দেখলো লেখা আছে–হেনরি লরেল। কার্ডটা উল্টে দেখলো-পেছনে অস্পষ্ট পেনসিলের লেখা। মনে হয় আগে কিছু লেখা হয়েছিলো, পরে ঘষে তুলে দেওয়া হয়েছে। ওখানে, সঙ্কেতলিপিটা এই কথা দিয়ে শুরু হয়েছে। মাঝখানের শব্দগুলোর পাঠোদ্ধার করা গেলো না। শেষদিকে আর একটা শব্দ পরক্ষণেই মনে হলো এটা কোনো গল্প বা প্রবন্ধের উদ্ধৃতিও তো হতে পারে। কার্ডটা ব্যাগে রেখে দিলো।
হঠাৎ চোখের ওপর একটা ছায়া পড়তে সে আঁতকে উঠে চোখ তুললো। একটু দূরে সূর্য আড়াল করে মিঃ অ্যারিস্টাইডস দাঁড়িয়ে রয়েছেন। নিচের বাগান ছাড়িয়ে দুরের আবছা পাহাড়ের শোভায় দৃষ্টি নিমগ্ন।
খাবার ঘরে এসে দেখলো হিলারী মিঃ অ্যারিস্টাইড আজও সেই একই টেবিলে বসে খাচ্ছেন।
বিকেলটা সাদামাটাভাবে কেটে গেলো। বাগান থেকে চত্বরে আবার বাগানে ঘুরে ঘুরে বেড়ালো হিলারী।
জামা প্যালেসের বাগানের সৌন্দর্য, হিলারীর মনের এই একাকিত্বে হাজার গুণ সুন্দর হয়ে ফুটে উঠল। যখন শান্তির শেষ অংশটুকুও সে ত্যাগ করেছে, তখনই শান্তির দেখা পেলো। মনের শান্তিটাও তখনই এলো, যখন সে মরণখেলায় ঝাঁপিয়ে পড়তে অঙ্গীকারবদ্ধ। একঝলক ঠান্ডা হাওয়া এসে হিলারীকে একটু ঝাঁপিয়ে দিয়ে গেলো। তারপর হয়তো এই সুন্দর বাগানে কটা দিন নিশ্চন্তে কাটবে।
বিকেল যখন ফুরিয়ে এলো চত্বরের পর চত্বর পেরিয়ে হিলারী হোটেলে ফিরে এলো।
হিলারী হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখলো লাউঞ্জে একজন ভদ্রমহিলা বসে আছেন যাকে হিলারী চেনে। তিনি কেলভিন বেকার। আসুন ভাই, আসুন, বেকার সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। আমিও চলে এলাম। এইমাত্র প্লেন থেকে নামছি।