ক্লান্তিভরে একটা চেয়ারে বসে পড়লো হিলারী। বিড় বিড় করে বললো, হ্যাঁ আমার নিজেরই মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয় না। দুর্ঘটনার আগের চব্বিশটা ঘণ্টা এখনো আমার কাছে সম্পূর্ণ অন্ধকার।
তা তো হবেই, ম্যানেজার বললো। ম্যানেজার নিচু হয়ে অভিবাদন জানিয়ে বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর হিলারী নিজেকে আয়নায় দেখে নিল।
ইতিমধ্যেই সে খোঁজ নিয়েছে তার নামে কোনো চিঠিপত্র এসেছে কিনা। ওঁর হাতে এখন কোনো সূত্রই নেই। শুধুমাত্র অলিভ বেটারটনের ছাড়পত্র, হুণ্ডি আর কুক-এর কাটা টিকিট আর আসন সংরক্ষণের চিঠিই তার সম্বল। ওর কাজ শুধু অলিভ বেটারটনের ভূমিকায় ঠিকমতো কাজ করা। প্লেন দুর্ঘটনা আর তার ফলস্বরূপ স্মৃতিলোপ এবং সাধারণ একটা অস্বচ্ছতাই তার হাতে তুরুপের তাস।
দুর্ঘটনা যেমন সত্যি, তেমনি অলিভ বেটারটনও যে সেই প্লেনে ছিলো সেটাও সত্যি। তার প্রতি যা যা নির্দেশ ছিলো, সেগুলো সে যদি পালন করতে না পারে, স্মৃতিভ্রষ্টতাই তার জন্য দায়ী।
এখন চুপচাপ শুয়ে বসে বিশ্রাম নেওয়াই তার পক্ষে সবচেয়ে স্বাভাবিক কাজ হবে। অলিভের মালপত্র সব প্লেনের মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মাত্র কয়েকটা জিনিষ ওরা হিলারীকে হাসপাতালে দিয়ে গিয়েছিলো। আস্তে আস্তে সে চুল আঁচড়ে খাবার ঘরে নেমে এলো।
অনেকগুলো চোখ যে তাকে লক্ষ্য করছে এটা বুঝতে ওর দেরি হলো না। তাদের সবার কথাবার্তা কানে আসতেই সচেতন হয়ে উঠলো হিলারী।
নৈশাহার শেষ করেও হিলারী কিছুক্ষণ বসে রইল। যদি কেউ যেচে আলাপ করতে আসে। ঘরে দুটি মহিলা ছাড়া আর কেউ নেই। তাদের মধ্যে একজন আমেরিকান কায়দায় আলাপ শুরু করলেন।
-কিছু মনে করবেন না, একটু আলাপ করতে এলাম। আপনি তো সেই প্লেন দুর্ঘটনা থেকে আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে ফিরেছেন, তাই না?
হিলারী বললেন–হ্যাঁ।
–মাত্র তিনজন বেঁচেছেন বলে শুনেছি, সত্যি?
দুজন, তিনজনের একজন হাসপাতালে মারা গেছে।
–কিছু যদি মনে করেন তাহলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। মিসেস বেটারটন, আপনি প্লেনের ঠিক কোন জায়গাটায় বসেছিলেন? একেবারে সামনে, না পেছনের দিকে?
হিলারীর উত্তরটা জানা ছিল সে বললো, পেছন দিকে।
ঐ ভদ্রমহিলা আরেকজন ভদ্রমহিলাকে ডেকে বললেন, শুনলেন তো মিস হেদারিংটন? যখন প্লেনে চড়বেন কক্ষনো সামনের দিকে বসবেন না।
ভদ্রমহিলা বললেন, আমার নাম কেলভিন বেকার। আমি মোগাডোর থেকে এখানে এসেছি আর হেদারিংটন এসেছেন তাঞ্জিয়ের থেকে। যা বেড়াতে এসেছেন ম্যারাকেশটা একবার ঘুরে আসবেন মিসেস বেটারটন।
সেইরকমই ব্যবস্থা ছিলো, হিলারী বললো, কিন্তু মাঝপথে সব ওলোট-পালট হয়ে গেলো প্লেন দুর্ঘটনার জন্য।
–তা ঠিক। কিন্তু ম্যারাকেশ যাওয়া বাতিল করবেন না যেন, আপনি কি বলেন, মিস হেদারিংটন?
–আর কোথায় কোথায় যাবেন, মিসেস বেটারটন? কেলভিন বেকার জিজ্ঞাসা করলেন।
-ফেজটা ঘুরে আসার খুব ইচ্ছে; বললো হিলারী, অবশ্য আবার নতুন করে ব্যবস্থাপত্র করতে হবে–
-হ্যাঁ, তাই করুন। ফেজ বা রাবাত কোনোটাই দেখতে ভুলবেন না।
আপনি বুঝি গিয়েছিলেন?
–না এখনও যাইনি। তবে শীগগিরই যাবো ভাবছি। হিলারী মনে মনে ঠিক করলো আগামীকাল সে যদি কোনো খবরাখবর বা কোনো নির্দেশ না পায় তাহলে কুক-এর ওখানে গিয়ে ফেজ বা ম্যারাকেশ যাবার নতুন বন্দোবস্ত করা যায় কি না সে সম্পর্কে খোঁজখবর নেবে।
পরের দিন সকালে কোনো খবর বা টেলিফোন এলো না। সে ভ্রমণসংস্থা কুক-এর অফিসে চলে এলো। টিকিট ঘরের সামনে আসতেই একজন বয়স্ক কেরানী বললো, আপনি তো মাদাম বেটারটন, তাই না? আমি আপনার সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।
–কিন্তু ওগুলোর তো সবদিন পার হয়ে গেছে, হিলারী বললো। আমি কদিন হাসপাতালে ছিলাম আর…
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেসব আমি জানি। আপনার এই পুনর্জন্মের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। নতুন করে যাত্রার ব্যবস্থা করার জন্য আপনার ফোন পেয়ে আমরা সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।
বুকের হৃদস্পন্দন দ্রুততর হয়ে উঠলো হিলারীর। যতদূর জানে সে টিকিটের জন্য এদের কাছে কারোও টেলিফোন করার কোনো কথা নেই। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে অলিভ বেটারটনের ভ্রমণসূচীর ওপর কারো তীক্ষ্ণদৃষ্টি রয়েছে। বললো, ও ওরা টেলিফোন করেছে কিনা ঠিক জানতাম না আমি।
-নিশ্চয়ই করেছে, মাদাম। এই যে রেলের টিকিট, হোটেলের ব্যবস্থাপত্র সব।
হিলারী হোটেলে ফিরে এলো। পরদিন হিলারী ফেজ-এর ট্রেনে রওয়ানা হলো।
সেদিনই বিকেলে মিসেস কেলভিন বেকারকে দেখে মিস হেদারিংটন এগিয়ে এসে বললেন, জানেন ভাই, সেই নামটা মনে পড়েছে–বেটারটন–আর সেই যে একজন বিজ্ঞানী হঠাৎ উধাও হয়ে গেলো। আমি কিন্তু ভাবছি–ওই ভদ্রমহিলাই ওঁর স্ত্রী কিনা–আপনার কী মনে হয়?
০৬. ক্যাসাব্লাঙ্কা হিলারী
০৬.
ক্যাসাব্লাঙ্কা হিলারীকে খুবই হতাশ করেছে। কোথায় সেই প্রাচ্যের ছাপ, কোথায়ই বা তার সেই বহুশ্রুত অলৌকিক মায়া! সবকিছুই যেন জমজমাট একটা ফরাসি শহরের মতো–তফাত শুধু রাস্তার মানুষগুলো।
এক ফরাসি লোকের সঙ্গে তার আলাপ হলো। সে হিলারীকে বললো, রাবাতটা একবার ঘুরে আসবেন, মাদাম, চমৎকার জায়গা। রাবাত না যাওয়া মানে মস্ত ভুল করা।
হিলারী হাসলো। বললো, যাবার তো ইচ্ছে, কিন্তু আমার হাতে আর সময় নেই বেশি। তাছাড়া টাকাপয়সাও খুব কম। জানেনই তো, বিদেশে আসার সময় কত অল্প টাকা আনতে দেয়।