–আপনি কি আমার জন্য একটুও দুঃখ করবেন না?
–দুঃখ করবো, তোমার জন্য? একটুও না। বরং ভয়ঙ্কর বিপদ জেনেও এমন একটা কাজের দায়িত্ব নিতে পারে এমন একজনকে হারাতে হচ্ছে বলে মনে মনে অজস্র অভিসম্পাত দেবো।
এবার হিলারী জেসপকে বললো, আমার আরেকটা কথা মনে হচ্ছে, অলিভ বেটারটনকে দেখতে কেমন ছিলো সেটা ওদের না জানারই কথা, কিন্তু আমাকে যদি কেউ হিলারী ক্র্যাভেন হিসাবে চিনে ফেলে। বিশেষ করে প্লেনের যাত্রীরা।
প্লেনের যাত্রীদের নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। তারা সোজা চলে গেছে। যা মিসেস বেটারটনের পোশাকগুলো তুমি পরবে, তার মতো করে চুল বাঁধবে আর মুখের একপাশে একটু পুলটিশ এঁকে নিলে তুমি একেবারে অন্য মেয়ে বনে যাবে। আর একজন ডাক্তার আসবেন তোমার গালে একটা আঁচড় কেটে দিতে। ওষুধ দিয়ে জায়গাটা আগেই অসাড় করে নেবেন। দুর্ঘটনার কয়েকটা সত্যিকারের চিহ্ন তোমার মুখে থাকতেই হবে।
–আপনার সবদিকেই দৃষ্টি আছে দেখছি!
–থাকতেই হবে।
হিলারী বললো, আপনি তো আমাকে একবারও জিজ্ঞেস করেননি, অলিভ বেটারটন মারা যাবার আগে আমাকে কিছু বলে গেছে কিনা।
আমি বুঝেছি, বলতে তোমার সঙ্কোচবোধ হয়েছে। সেজন্য আমি দুঃখিত।
দুঃখিত হবার কোনো কারণ নেই। এরজন্য তোমাকে আমি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আমি নিজে হলেও তাই করতাম।
–তার কথাটা আপনাকে জানোননা দরকার সে বলেছিলো, ওকে বোলো-মানে বেটারটনকে বোলো, সাবধান–বোরিস-সাংঘাতিক
বোরিস নামটা বারবার উচ্চারণ করতে লাগলেন জেসপ। ওহহ! আমাদের বিদেশী মেজর বোরিস গ্লাইদার!
–আপনি তাকে চেনেন–কে সে?
পোল্যান্ডের লোক। লন্ডনে একবার আমার সাথে দেখা করতে এসে বলেছিল ও নাকি অলিভ বেটারটনের পিসতুতো ভাই।
ভদ্রলোকের একটা বর্ণনা দিতে পারেন, তাহলে আমার পক্ষে তাকে চেনা সহজ হবে।
-হ্যাঁ, বলছি, ছফুট লম্বা। ওজন প্রায় ১৬০ পাউন্ড হবে। বেশ সুন্দর দেখতে। মুখটা একটু কাঠ কাঠ–ভাসা ভাসা চোখ, আচার-ব্যবহার একদম বিদেশী। হা-অলিভ বেটারটন যদি বলে থাকে যে ওই বোরিস গ্লাইদার সাংঘাতিক লোক–আমি বলবো সম্ভবত সে ঠিকই বলেছে।
.
০৫.
সেন্ট লুই হোটেলের বৈঠকখানা ঘরে বসে তিনজন মহিলা যে যার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। মিসেস কেলভিন বেকার, খাটো করে গোলগাল দেখতে, তার প্রতিটি কাজে দুরন্ত উৎসাহ, তিনি ঘরে বসে চিঠি লিখছিলেন। তাকে দেখে বোঝাই যায় তিনি পাকা একজন আমেরিকান গিন্নী।
ওদিকে একটা বাদশাহী চেয়ারে বসে বেশ অস্বস্তিতে পড়েছেন মিস হেদারিংটন। মিস হেদারিংটন বেশ লম্বা, রোগা চেহারার ওপর লিকলিকে ঘাড়, চুলগুলোও অবিন্যস্ত আর মুখে সারা দুনিয়ার একটা বিতৃষ্ণার ছাপ। এঁকে দেখে বোঝা যায় ভ্রমণ-পিয়াসী ইংরেজ মহিলা। তিনি বসে বসে উল বুনছিলেন।
মাদমোয়াজেল জীন ম্যারিকট হলেন আরেকজন মহিলা যিনি ঘরের জানালার পাশে বসে হাই তুলছিলেন এবং বাইরেটা দেখছিলেন। মাদামোয়াজেল ম্যারিকট দেখতে শ্যামাঙ্গী, মাথায় লালচে চুল, সাধারণ অথচ উগ্র প্রসাধনে মুখটা জ্বলজ্বলে। ঘরের কেকী করছে তাতে কোনো উৎসাহ নেই।
মিস হেদারিংটন এবং মিসেস কেলভিন বেকার দুটো রাত কাটিয়েছেন এই হোটেলে। সুতরাং তাদের মধ্যে আলাপ পরিচয়ও একটু আধটু হয়ে গেছে। মিসেস কেলভিন বেকার তার মার্কিনী বন্ধুসুলভ ব্যবহারে প্রায় সকলের সঙ্গেই আলাপ জমিয়ে ফেলেছেন। মিস হেদারিংটনের খুব ইচ্ছে সকলের সঙ্গে আলাপ করেন, কিন্তু তিনি উঁচু বংশ না পাওয়া পর্যন্ত কারো কাছে ঘেঁষেন না।
এক ফরাসি ভদ্রলোক, ঘরে একবার উঁকি মেরে বেরিলয়ে গেলেন। যাবার সময় জীন ম্যারিকটের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।
মিস হেদারিংটন মুখে শব্দ করে বোনের ঘর গুনতে লাগলেন, আটাশ, উনত্রিশ…।
লম্বা মতো একজন মহিলা এই ঘরের দিকে তাকিয়ে আবার খাবার ঘরের দিকে চলে গেলেন।
মিসেস কেলভিন বেকার এবং মিস হেদারিংটন দুজনেই সঙ্গে সঙ্গে সচকিত হয়ে উঠলেন।
মিসেস বেকার ফিসফিস করে বললেন, এই যে লালচুলো মহিলাটি ঘরের দিকে দেখছিলো, ওকে দেখলেন নাকি মিস হেদারিংটন? গত সপ্তায় যে সাংঘাতিক প্লেন দুর্ঘটনা হলো। তার একমাত্র জীবিত যাত্রী নাকি ও-ই।
মিস হেদারিংটন বললেন, বিকেলে আসতে দেখেছি ওঁকে। একটা অ্যাম্বুলেন্স ওঁকে দিয়ে গেছে এখানে। ওঁকে হাসপাতাল থেকে এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়া উচিত হয়নি। মাথায় নিশ্চয়ই জোর চোট লেগেছিলো–
–মুখে তো এখনও পট্টি লাগানো রয়েছে কাঁচে কেটেছিলো বোধহয়। কী ভাগ্য যে পুড়ে যায়নি, এইসব প্লেন দুর্ঘটনায় পুড়েই তো অর্ধেক লোক অকর্মণ্য হয়ে পড়ে।
-ওঃ! ভাবতেও ভয় করে। বেচারা কতই বা বয়েস।
কাগজে লিখেছিলো একজন মহিলাযাত্রী। হ্যাঁ, তাই বটে। নামটাও দিয়েছিলো–মিসেস বেভারলি না বেটারটন।
মাদমোয়াজেল ঘর থেকে বেরিলয়ে গেলেন, তার এইসব গালগল্প ভালো লাগছিলো না।
দুর্ঘটনার পাঁচদিনের দিন বিকেলবেলাই মিসেস অলিভ বেটারটন হাসপাতাল থেকে চলে গেলেন। অ্যাম্বুলেন্স তাঁকে সেন্ট লুই হোটেলে পৌঁছে দিয়ে গেলো।
অসুস্থ বেটারটনের বিবর্ণ মুখে এখানে-ওখানে পট্টি লাগানো, মাথায় ব্যান্ডেজ। হোটেলের ম্যানেজার সহানুভূতির সঙ্গে তাড়াতাড়ি তাঁকে সংরক্ষিত ঘরে পৌঁছে দিলো। খুব কষ্ট পেয়েছেন তাই না মাদাম?