কেন, বাইরে তো বেশ ভালই আছি তার হয়ে উত্তরটা দিলো ভেরা।
তা যা বলেছেন তাকে সমর্থন করে একটা সিগার ধরালো লম্বার্ড। ট্রেনে যা ধকল গেছে তার ওপর একটানা বসে থেকে হাতে পায়ে খিল ধরে গেছে। এখন একটু এদিক-ওদিকে চলে ফিরে না বেড়ালে পরে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারব না।
দুপা এগিয়ে গিয়ে প্রসঙ্গের জের টেনে বললো লম্বার্ড আপনি এর আগে কখনো আসেননি এখানে?
না এই তো প্রথম আসা। তাও আবার চাকরীর তাগিদে তা না হলে
সে কি। লম্বার্ডের দু চোখে গভীর বিস্ময়, আপনি নগর দ্বীপে চাকরী করতে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ মিসেস ওয়েন এখন আমার মনিব, অর আমি ওর সেক্রেটারি। কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানেন, মিসেস ওয়েনকে দেখার সৌভাগ্য এখনো আমার হয়নি।
ভারি তাজ্জব ব্যাপার তো?
হ্যাঁ, তাজ্জব ব্যাপারই বটে। শুনেছি ওঁর নিয়মিত সেক্রেটারি নাকি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মহিলা এজেন্সিকে টেলিগ্রাম করে একজন প্রার্থী চেয়ে আর এজেন্সি আমাকেই সুপারিশ করে পাঠালো এখানে।
তাই নাকি।
কি আর করার থাকতে পারে তখন, হতাশ গলায় বললো ভেরা, তখন ফিরে যাবো। এমনিতেই তো এ-চাকরী মাত্র একটি মাসের জন্য। একমাস পরে ঠিক ফিরে যেতেই হতো। তাছাড়া আমি তো আর একেবারে বেকার নই। আমি স্কুলে চাকরী করি, এখন এই ছুটির দিনগুলিতে অস্থায়ী একটা চাকরী জুটে গেলো। তাই প্রস্তাবটা গ্রহণ করলাম। ছুটির মাসে বাড়িতে বসে না থেকে বাড়তি কিছু টাকা রোজগার করলে মন্দ কি বলুন? এখানে আসার আগে এই নিগার দ্বীপ সম্বন্ধে কত কাহিনীই না শুনেছি, চাকরীর সুবাদে জায়গাটা নিজের চোখে দেখে নেওয়া যাবে। খাসা একটা জায়গা। আপনার কি মনে হয়?
আমার ঠিক জানা নেই। ভুরু কুঁচকে উঠলো লম্বার্ডের, আগে তো কখনো এখানে আসিনি, তা জানবো কি করে বলুন।
শুনেছি ওয়েনদের নাকি অগাধ টাকা। কিন্তু ওরা লোক হিসাবে কেমন জানেন কিছু?
আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল তো, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেই একই প্রশ্ন। এমন ভাব দেখাচ্ছে মেয়েটি যেন আমর মুখ থেকে ওয়েনদের সম্পর্কে সব জেনে-শুনে নিয়ে ভাল লাগলে তবে উনি চাকরীটা গ্রহণ করবেন। যত্ তো নেকামি আর কি?
প্রসঙ্গ পাল্টাতে লম্বার্ড জিজ্ঞেস করলো আচ্ছা আমরা এখন কার জন্য অপেক্ষা করছি বলুন তো?
জানি না তো। নিরুত্তাপ গলায় বললো ভেরা।
এই সময় যান্ত্রিক আওয়াজ তুলে একখানা ট্রেন এসে থামলো স্টেশনে। যাত্রীদের হৈ চৈ কোলাহলে আর এক প্রস্থ গম গম করে উঠলো প্ল্যাটফর্ম। এই ট্রেনে ঐ বোধহয় তিনি এলেন। বললেন লম্বার্ড।
লম্বার্ডের অনুমানই ঠিক। দীর্ঘ বলিষ্ঠ চেহারার এক পৌঢ়কে স্টেশন থেকে বেরিয়ে, আসতে দেখা গেলো। কাঁচা-পাকায় মেশানো মাথা ভর্তি চুল ঠোঁটের ওপরে মিলিটারি গোঁফ, চোখে সন্ধানী দৃষ্টি, তার পিছনে লটবহর মাথায় একটা কুলি।
এগিয়ে গিয়ে বললো ভেরা, আমিই মিসেস ওয়েনের সেক্রেটারী। আসুন আমার সঙ্গে, আপনার জন্য ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। তারপর লম্বার্ডের দিকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ভেরা বললো, আমার সঙ্গী মিঃ লম্বার্ড।
একজোড়া ধোঁয়াটে নীল চোখ স্থির নিবদ্ধ হয়ে রইলো লম্বার্ডের মুখের ওপরে। অনেকক্ষণ পরে মুখ ফেরাতে গিয়ে তার চোয়াল দুটো কঠিন হয়ে উঠতে দেখা গেল। স্বগোক্তি করেন তিনি দেখতে তো বেশ খাসা, কিন্তু।
কথাটা অসমাপ্ত রেখেই, ভেরাকে অনুসরণ করে সেই দ্বিতীয় ট্যাক্সিতে উঠে বসলেন জেনারেল ম্যাকআর্থার। তাকে অনুসরণ করলো ভেরা এবং লম্বার্ড। তারপর ওক ব্রীজ স্টেশন ছেড়ে এসে প্লিমাউথ রোড ধরে দ্রুত বেগে ট্যাক্সি ছুটে চললো। গ্রাম্য পথ।
ডিভনের একদিকটায় আমার এই প্রথম আসা, ধরা গলা পরিষ্কার করে বললেন। জেনারেল ম্যাকআর্থার। আমার বাড়ি পূর্বে ডরমেটের সীমান্তে কিন্তু তার গণ্ডি ছাড়িয়ে এদিকে আমার সময় আর করে উঠতে পারিনি এর আগে।
জায়গাটা দারুণ চমৎকার। ভেরার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, দেখুন, দেখুন কেমন ছোট ছোট পাহাড় মাটি কেমন রুক্ষ লাল সবুজ অরণ্য, একটা সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ।
তা যতোই সুন্দর হোক না কেন, মৃদু আপত্তি করে উঠলো লম্বার্ড, খোলামেলা জায়গাই আমার বেশি পছন্দ। এইসব পাহাড় অরণ্যের পরিবেশ চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে আমাদের। এর বাইরে দুনিয়ার আর কোথাও কি ঘটছে না ঘটছে তা কিছুই বোঝবার উপায় নেই এখান থেকে।
মনে হচ্ছে দুনিয়াটা চষে বেড়িয়েছেন আপনি। হাল্কা হাসি হেসে বললেন ম্যাকআর্থার। তা একটু আধটু ঘুরেছি বৈকি। তার চোখের দিকে ভাল করে তাকাতে পারলো না লম্বার্ড। তার ভয়, এই বুঝি তিনি আবার প্রশ্ন করে বসেন এরপর তা আপনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন তো? জিজ্ঞেস করলে কি উত্তর দেবে সে।
যাইহোক লম্বার্ডের আশঙ্কা সত্য হলো না, জেনারেল ম্যাকআর্থার প্রশ্নটা আদৌ করলেনই না।
একটা পাহাড় টপকে রাস্তাটা শেষ পর্যন্ত এসে মিশেছে সমুদ্রের প্রশস্ত বালিয়াড়িতে। জায়গার নাম স্টিকলহ্যাভেন। সমুদ্রতীর সংলগ্ন ছোট্ট একট গ্রাম, সমুদ্রের ধারে মাছ ধরার নৌকো ইতস্তত ছড়ানো।
পাকা টম্যাটোর মতো লাল সূর্যটা তখন অস্তাচলে। আকাশে বেলা শেষের রক্তিমাভা। দূরে দক্ষিণদিক ঘেঁষে সমুদ্রের মাঝখানে অন্তহীন আকাশের পটভূমিকায় মাথা উঁচু করে ধ্যানমগ্ন যোগীর মতো সারি সারি পাহাড়, প্রহর গুণছে–আর ওটাই হল নিগার আইল্যাণ্ড।