আমার পরিচয় কি যেন হবে? হ্যাঁ দক্ষিণ আফ্রিকার লোক হবো আমি। হুঁ দক্ষিণই ভাল। ঐ অঞ্চলে বড় একটা যায় না কেউ। আর মনে হয় না, দলের কেউ দক্ষিণ আফ্রিকায় গেছে কখনো। টুরিস্টগাইড পড়ে ঐ অঞ্চলের সব জায়গাগুলো মোটামুটি ভাবে মুখস্থ হয়ে গেছে, মনে হয় প্রশ্নবানে কেউ আমাবে নাজেহাল করতে পারবে না। দক্ষিণ আফ্রিকা উপনিবেশ হওয়ায় সুবিধে অনেক, পৃথিবীর সব দেশের লোকজনদের যাতায়াত আছে ওখানে। আমিও যেন গিয়েছিলাম সেখানে ভাগের অন্বেষণে, মোটা টাকা রোজগার করে ফিরছি। এটাই যথেষ্ট, সমাজে মিশতে আমাকে কে আর আটকায় এখন?
নিগার আইলান্ড। ছোটবেলায় একটা অস্পষ্ট স্মৃতি এখন মনে পড়ছে, নদীতীর থেকে মাইল খানেক দূরে সেই পাহাড় শঙ্খচিলের ঝাঁক আকাশে অনেক উঁচু আকাশে তাদের কতকটা ফুলস্টপের মতো মনে হতো, পাহাড়টা দেখতে ছিলো অনেকটা। মানুষের মাথার মতো কালো কুচকুচে মাথা, পুরু ঠোঁট, নামটাও তাই নিগার আইল্যাণ্ড, নিগার অপভ্রংশ নিগার।
সত্যি ভাবতে অবাক লাগে, এমন এক নির্জন অখ্যাত দ্বীপে গিয়ে যে কেউ অমন বিরাট প্রাসাদ বোঝাতে পারে। জায়গাটা তেমন আকর্ষণীয় কিংবা লোভনীয় তেমন নয়। তাছাড়া ওখানকার আবহাওয়া শোনা যায় মাঝে মাঝে খুব বিশ্রী হয়ে ওঠে। তবে কোটিপতিদের কাছে সব রকম খেয়ালই শোভা পায়। অঢেল টাকা থাকলে কারোর মাথায় এমন অদ্ভুত অদ্ভুত খেয়াল আসে বৈকি। তা না হলে…থাক, বিত্তবানদের খেয়ালীপনা নিয়ে আমার অতো চিন্তা কিসের? যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমি যাচ্ছি সেটা পূরণ হলেই যথেষ্ট।
সেই এক মাত্র যাত্রীটির ঘুম ভাঙতেই তাকালো তার দিকে, সমুদ্রের তীরে তো যাচ্ছেন, তবে সমুদ্রকে যেন বিশ্বাস করবেন না কখনো।
হ্যাঁ যা বলেছেন
ঝড় এলো বলে। লোকটি আপন মনে বিড়বিড় করে বকলো।
ঝড়? অবাকই হলেন মি. ব্লোর ঝড় আসতে যাবে কেন.এখন সেখানকার আবহাওয়া তো শুনেছি চমৎকার।
চমৎকার! আবহাওয়া কারোর কোনো কথার তোয়াক্কা করে না, বুঝলেন মশাই। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ঝড় আসছে সেখানে প্রচণ্ড বেগে।
লোকটির অনুমান নিয়ে অহেতুক তর্কে যেতে চাইলেন না মিঃ ব্লোর, তাই চুপ করে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করলেন তিনি।
একটা স্টেশনে ট্রেনটা থামতেই উঠে দাঁড়ালো লোকটি। এখানে আমাকে নামতে হবে। দরজার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে আবার সে, পিছনে ফিরে সেই সাবধান বাণীটি উচ্চারণ করতে ভুললো না, মনে রাখবেন, ঝড় আসছে। ঈশ্বরে নাম জপ করুন। এবার বিচার হবে সেখানে, সবার। সমাধান। ট্রেন থেকে নেমে আর একবার মনে করিয়ে দিলো সে কথাটা কিন্তু মনে রাখবেন। আপনাদের বয়স কম, আর অভিজ্ঞতাও কম। তাই বলতে বাধ্য হচ্ছি, এবার বিচার হবে মরার শেষ বিচার। ঝড় এলো বলে…..
তাতে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই মিঃ ব্লোর-এর। নিরাসক্ত ভঙ্গীতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে আপন মনে তাচ্ছিল্য ভরে বললেন শেষ বিচার যদি কারো হয় তো আগে তোমারি হবে বুঝলে বাপু। বয়স তো প্রায় কাবার করে এসেছে।
বলার পরেই সঙ্গে সঙ্গে তার আবার মনে হলো বোধহয় ভুলটা তারই হলো। তাই কি বিচারের কাঠগড়ায় তাকেই দাঁড়াতে হলে সবার আগে—
.
০২.
এই সময় ট্রেনটা থামলো ওকব্রীজ ষ্টেশনে, একে একে তারা চারজন নেমে দাঁড়ালেন ট্রেন থেকে। তাদের দেখে একজন ট্যাক্সি চালক এগিয়ে এলো কে যাবেন নিগার আইল্যাণ্ডে?
আমি–প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠলেন চারজন। তারপর এ ওর মুখের দিকে তাকালেন অবাক চোখে।
ওঁদের মধ্যে মিঃ ওয়ারগ্রেভই ছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ, তাই ট্যাক্সি চালক জিন তাকেই দলনেতা বলে ধরে নিয়ে তার উদ্দেশ্যে বললো, এখানে ট্যাক্সি মোটে দুখানা স্যার। আর একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেন না আসা পর্যন্ত একখানা এখানেই থাকবে। ঐ ট্রেনে আরো কয়েকজন আসছেন। আমার ট্যাক্সিতে আপনাদের মধ্যে তিনজন চলে আসুন, বাকি একজন থেকে যান, উনি এলে ওর সঙ্গে যাবেন।
তাহলে আমি বরং থেকে যাই, আপনারা ওর ট্যাক্সিতে চলে যান, বললো ভেরা ক্লেথর্ন।
ধন্যবাদ, মিস ব্লেন্ট এগিয়ে গেলেন জিনের ট্যাক্সির দিকে। সাবধানে মাথা নিচু করে শরীরটাকে ট্যাক্সির ভেতরে গলিয়ে দিলেন তিনি। তার পিছনপিছন ঢুকলেন বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ।
তখনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে লম্বার্ড একটু ইতস্ততঃ করে সবশেষে তার মনের কথাটা বলেই ফেললো, ভাবছি আমিও থেকে যাই কি বলেন মিস–
ক্লেথর্ন–আমার নাম ভেরা ক্লেথর্ন।
আর আমি হলাম ফিলিপ লম্বার্ড। ভেরার দিকে সে তার হাতটা বাড়িয়ে দেয়।
ওদের দুজনকে নিয়ে জিনের ট্যাক্সি ছুটে চললো ওকব্রীজের দিকে। ট্যাক্সির আসনে হেলান দিয়ে বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন, রোদটা আজ তেমন চড়া নয় বলেই যা রক্ষে।
হ্যাঁ তা যা বলেছেন। আবহাওয়া তো বেশ ভাল বলেই মনে হচ্ছে। মিস ব্লেন্ট আড়চোখে একবার ওয়ারগ্রেভকে দেখে নিয়ে নিজের মনেই বললো, দেখে তো মনে হচ্ছে সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোক।
জানালার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বললেন ওয়ারগ্রেভ এই প্রথম নাকি এর আগে কখনো এসেছেন এদিকে?
না ডিভনের এদিকে এই প্রথম আমার আসা।
এবং আমারও। এর আগে এখানে আসা আমার সৌভাগ্য হয় নি।
ট্যাক্সি তখন ছুটে চলেছে তীব্রবেগে ফাঁকা রাস্তায়।
ভেরা ও লম্বার্ড মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভাবছিল, কে প্রথম আলোচনা শুরু করবে। এই সময় দ্বিতীয় ট্যাক্সিচালক তাদের কাছে এসে সবিনয়ে অনুরোধ করল, বাইরে না দাঁড়িয়ে আপনারা আমার ট্যাক্সিতে উঠে বসতে তো পারেন স্যার; প্রস্তাবটা লম্বার্ডকে উদ্দেশ্য করে বলা।