অতি নিখুঁত ভাবে কাজটা করে গেলো, মিস্ ক্লেথন তার ঘরের ঝুলন্ত শ্যাওলা দেখে চিৎকার করে বাড়ি মাত করে তুললো, অনেক চিন্তা ভাবনা করে তার ঘরে শ্যাওলা ঝুলিয়ে রেখে এসেছিলাম আগেই। তার চিৎকার শুনেই সবাই দোতলায় তার ঘরের উদ্দেশ্যে ছুটলো। এই সুযোগে রং টং মেখে খুনীর পোজ দিয়ে ফেললাম।
কাল্পনিক মৃত অবস্থায় আমাকে দেখে তাদের মনে যে প্রতিক্রিয়া হলে সেটা ছিলো একান্ত কাম্য। পেশাদার অভিনেতার মতো অভিনয় করলো ডঃ আর্মস্ট্রং। তারা আমাকে ধরাধরি করে নিয়ে গেলো ওপর তলায়। আগেই আর্মস্ট্রং আমাকে পরীক্ষা করে তাদের জানিয়ে দিয়েছিল, আমি মৃত। তারা আমার মৃতদেহ আমার বিছানায় শুইয়ে দিলো। আমার ব্যাপারে কাউকেই চিন্তিত বলে মনে হলো না, তারা নিজেরা সবাই মৃত্যু ভয়ে আতঙ্কিত এবং সবাই এ ওর ভয়ে শঙ্কিত। ব্যবস্থা মতো রাত সোয়া দুটোর সময় আমি ও আর্মস্ট্রং মিলিত হলাম বাড়ির বাইরে। আমি তাকে কাছেই একটা পাহাড় চূড়ায় নিয়ে গেলাম। আমি তাকে বললাম, কেউ বাড়িতে প্রবেশ করলে আমরা এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাবো, তবে বাড়ি থেকে কেউ আমাদের দেখতেও পাবে না। তবু তা সত্বেও স্মরণ করিয়ে দিতে হবে তাকে, ছেলেবেলার সেই কবিতাটা যদি সে মনে রেখে থাকে। সিন্ধু পাখী হজম করলো একজনকে…..।
ব্যাপারটা ছিলো খুব সহজ। পাহাড়ের চূড়ার ধারে গিয়ে হঠাৎ আমি চিৎকার করে উঠে তাকাতে বললাম তাকে ঐ দেখ, ওটা একটা গুহা না? সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকে পড়লো সে। কাজটা দ্রুত সারাতে হলো। ভয়ঙ্কর একটা ধাক্কা দিলাম তাকে, সঙ্গে সঙ্গে ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো সে এবং নিমেষে পাহাড়ের চূড়া থেকে তার ভারি দেহটা পড়লো নিচে। বাড়ি ফিরে এলাম। আমার শব্দ নিশ্চয়ই শুনে থাকবে ব্লোর। আর্মস্ট্রং এর ঘরে ফিরে আসার কয়েক মিনিট পরে আবার ফিরে চললাম, তার আগে বেশ কয়েবার পায়ের শব্দ করলাম যাতে কেউ না কেউ শুনতে পায়। সিঁড়িতে নামার পথে দরজা খোলার শব্দ হলো। সামনের দরজা দিয়ে বাড়ির বাইরে যাওয়ার সময় পিছন থেকে তারা নিশ্চয়ই অন্ধকারে আমার ছায়ামূর্তিটা দেখে থাকবে আমাকে আর্মস্ট্রং ভেবে।
তারা আমাকে অনুসরণ করছে দেখে তখন দেওয়াল ঘেঁষে পা টিপে টিপে বাড়ির পিছন দিকে এসে সাবধানে পাঁচিল টপকে খাবার ঘরের কাছে এলাম। জানালা আগে থেকে খুলে রেখেছিলাম। জানালা বন্ধ করে শার্সির কাঁচ ভেঙ্গে খাবার ঘরে ঢুকে পড়লাম। তারপর ওপরতলায় গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে যথারীতি আবার আমার বিছানায় শুয়ে পড়লাম মরার মতোন।
অনুমান করে নিলাম তারা আবার তল্লাসি চালাবে সারা বাড়িটায়, তবে আমার মনে হয় না, মৃতদেহগুলো খুব কাছ থেকে পরীক্ষা করে দেখবে। তবে হয়তো নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য তারা মৃতের চাদর সরিয়ে দেখতে চাইবে, চাদরের আড়ালে আর্মস্ট্রং তার দেহটা ঢেকে রেখেছে কি না। আর ঠিক সেই রকমটিই ঘটতে দেখা গেলো।
হ্যাঁ, ভাল কথা, লম্বার্ডের ঘরে রিভলবারটা আবার রেখে দেওয়ার কথাটা বলতে একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। কারোর হয়তো জানার আগ্রহ হবে, সেটা কোথায় আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম। বিস্কুটের টিনে ভর্তি ছিলো ভাড়ার ঘর। একেবারে নিচের একটা বিস্কুটের টিনের ঢাকনা খুলে রেখে দিই রিভলবারটা এবং ঢাকনা লাগিয়ে তাতে অ্যাডহেসিভ টেপ লাগিয়ে দিই।
লাল পর্দাটা লুকিয়ে রাখি ড্রইংরুমের একটা চেয়ারের আবরণের নিচে আর উলের গোলাটা লুকিয়ে রাখি চেয়ারের জর্দা কাটা ছোট একটা গর্তে।
এরপর আমার ছকে বাঁধা পরিকল্পনা মাফিক দেখলাম তারা তিনজনে প্রত্যেকে প্রত্যেকের ভয়ে দারুণ ভীত, সবাই সবাইকে সন্দেহ করেছে মনে মনে, কিন্তু কেউ কাউকে অপরাধী সাব্যস্ত করতে পারছে না, প্রমাণের অভাবে। তাদের মধ্যে একজনের হাতে আবার একটা রিভলবার। ঘরের জানালা দিয়ে আমি তাদের লক্ষ্য করলাম। ব্লোর যখন একা এদিক এগিয়ে এলো, আমি তখন একটা বড় সাইজের মার্বেল পাথরের টেবিল ক্লথ হাতে নিয়ে প্রস্তুত হলাম। এবার ওর যাওয়ার পালা, ওর আর বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই। একেবারে জানালার নিচে আসতেই ওকে লক্ষ্য করে মার্বেল পাথরের ঘড়িটা সজোরে নিক্ষেপ করলাম। অব্যর্থ লক্ষ্য, বিদায় নিলো ব্লোর, চির দিনের মতো…।
তারপর আমার জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেই দেখলাম, লম্বার্ডকে গুলি করলো ভেরা ক্লেথ, দক্ষ, তৎপর এবং দুঃসাহসী যুবতী। লম্বার্ড ও ক্লেথর্নকে একসঙ্গে দুজনকে মেলামেশা করতে দেখে সব সময় আমার মনে হতো, মেয়েটি যেন লম্বার্ডের বেশ মানানসই। তবু সেই অপ্রিয় ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পরই আমার নাট্য মরে শেষ অভিনয়ের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য তৎপর হলাম। মঞ্চ সাজালাম ভেরার ঘরে।
এটা একটা মনস্তাত্বিক পরীক্ষা নিরীক্ষা। অবচেতন মনে ভেরার নিজের অপরাধের জন্য টেনশন ও নাভাসের ফলস্বরুপ হঠাৎ একজনকে গুলি বিদ্ধ করা তার আত্মহননের জন্য সম্মোহিত করার পক্ষে এ দুটি কারণই যথেষ্ট নয় কি? আমার ধারণা এমনটি হওয়া উচিত। এবং হলোও তাই, আমরা অনুমানই ঠিক ওয়ার ড্রোবের পাশে ছায়া ঘন আঁধারের সামনে দাঁড়িয়ে আমার চোখের সামনে ভেরা ক্লেথর্নকে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়তে দেখলাম।
তখন বাকী রইলো মঞ্চের দৃশ্য। এগিয়ে গেলাম। ভেরার পায়ের তলা থেকে চেয়ারটা সরিয়ে দেওয়াল ঘেঁষে রেখে দিলাম। রিভলবারটার খোঁজ করলাম বাইরে এসে সিঁড়ির একেবারে ওপর ধাপের উপর, সন্ধান পেলাম সেটার। সেখানে রেখে দিয়েছিল ভেরা। রিভলবারের ওপর তার হাতের ছাপ রাখার জন্য সব রকম সর্তকতা অবলম্বন করলাম।