নিগার দ্বীপে কার বিরুদ্ধে কি রকম মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করা হবে, এ নিয়ে আমি বিশেষ চিন্তা ভাবনা করেছিলাম। আমার অতিথিদের অপরাধের তারতম্য বিচার করে আমি ঠিক করে ফেলি, যার অপরাধ সব থেকে কম, তাকে আগে মরে যেতে হবে, কারণ আমি চাই না মৃত্যু ভয়ে অহেতুক বেশী মাথা ঘামাক সে, আর একটা ঠাণ্ডা মাথায় খুনের জন্য আতঙ্কে সিটকে উঠুক সে।
অ্যান্টনি মাস্টার্ন এবং মিসেস রগার্সকে সবার আগে মরতে হলো, একজন সঙ্গে সঙ্গে আর একজন ঘুমের মধ্যে শান্তিতে। মাস্টার্নকে আমি জানি, নৈতিক দায়িত্ববোধ বলতে তার কিছু ছিলো না। যা আমাদের সবারই আছে। মিসেস রগার্স, আমার কোনো সন্দেহ নেই, তার স্বামীর প্ররোচনায় অভিনয় করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।
তারা দুজন কি ভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি হলো, বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই না এখানে। এ কাজ পুলিশের, সহজেই অবিষ্কার করতে পারবে তারা। বাড়ির পোকা মাকড় মারার জন্য অতি সহজেই পটাশিয়াম সায়ানাইড সংগ্রহ করা যায়। সংগ্রহের কিছু অবশিষ্ট ছিলো আমার সঙ্গে। গ্রামাফোনে সেই সব ভয়ঙ্কর উক্তিগুলো উচ্চারিত হওয়ার পর অতিথিদের মনে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, সেই ফাঁকে প্রায় একটা খালি গ্লাসে একটু পটাসিয়াম সায়ানাইড ফেলে রাখি।
সেই সময় আমি আমার প্রতিটি মুখের দিকে তাকিয়ে নিরীক্ষণ করেছিলাম। এবং আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আমার কোনো সন্দেহ ছিলো না, প্রত্যেকেই অপরাধী।
ইদানীং আমার মাথার যন্ত্রণার দরুণ ঘুমের ওষুধ ক্লোরাল হাইড্রেট খেতে হতো আমাকে, আর সেই ট্যাবলেট আমার কাছেই ছিল। রগার্স যখন তার অসুস্থ স্ত্রীর জন্য ব্র্যান্ডি নিয়ে এসে টেবিলের ওপর রাখে। সেখান দিয়ে যেতে গিয়ে ব্র্যান্ডির গ্লাসে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিই, তাতেই কাজ হয়ে গেলো। রগার্সের স্ত্রীর ঘুম আর ভাঙলো না। ব্যাপারটা খুব সহজেই মিটে গেলো, সেই সময় কারোর মনে কোনো রকম সন্দেহই জাগলো না।
নিঃশব্দে মৃত্যু এসে বললো জেনারেল ম্যাকআর্থারকে এবার তোমার পালা। না, কোনো জ্বালা যন্ত্রণা ছিলো না সেই মৃত্যুতে। তবে টেরেস ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়টা খুব সাবধানে বেছে নিতে হয়েছিল আমাকে, কিন্তু সব কিছুই সফল হয়েছিল।
আমার অনুমান মতো খুনীর সন্ধানে সারাটা দ্বীপ তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো, এবং আবিষ্কার করা হলো, আমরা সাতজন ছাড়া অন্য আর কেউ ছিলো না। সঙ্গে সঙ্গে একটা সন্দেহের আবহাওয়া সৃষ্টি হলো নিগার দ্বীপে। আমার প্ল্যান মাফিক তখন আমার একজন সহকারীর প্রয়োজন হয়ে পড়লো। ডঃ আর্মস্ট্রংকেই বেছে নিলাম। ফাঁদে পড়ার মতো লোকই বটে সে। আমার নাম যশ এবং একবার চোখের দেখায় আমার চিনতো সে। আমার মতো লোক যে খুনী হতে পারে সেটা ছিলো তার ধারণার অতীত। তার সব সন্দেহ গিয়ে পড়েছিল লম্বার্ডের ওপর। এবং তার এরকম একটা ধারণার প্রতি আমার যে সমর্থন ছিলো সেই রকম ভান করতে থাকি। আমি তাকে আভাষে জানালাম, খুনীকে হাতেনাতে ধরার একটা মতলব আমার মাথায় এসেছে।
প্রত্যেকের ঘরে তল্লাসি চালানো হলেও তাদের কারোরই দেহ তল্লাসি হয়নি তখনো পর্যন্ত।
দশই আগস্ট সকালে খুন করলাম রগার্সকে। উনুন জ্বালাবার কাঠ কাঠছিলো সে তখন পিছন ফিরে, তাই সেখানে আমার উপস্থিতি একেবারেই টের পায়নি, তার পকেটে খাবার ঘরের চাবির সন্ধান পেলাম।
রগার্সের দেখা না পেয়ে বিভ্রান্ত সবাই তার খোঁজে বেরিয়ে পড়তেই সেই সুযোগে অতি সন্তপণে লম্বার্ডের ঘরে ঢুকে তার রিভলবারটা হস্তগত করলাম। তার কাছে সেটা যে থাকার কথা আমি জানতাম। সত্যি কথা বলতে কি মরিসের সঙ্গে তার সাক্ষাতকারের সময় সে যেন এ ব্যাপারে সেরকম পরামর্শই দেয় তাকে।
ব্রেকফাস্টের সময় মিস্ ব্লেন্টের কফির কাপে কফি ঢালতে গিয়ে ঘুমের ওষুধ ক্লোরালের শেষ ডোজটুকু মিশিয়ে দিলাম। খাবারঘরে তাকে রেখে আমরা বেরিয়ে এলাম। একটু পরেই সেখানে ফিরে গেলাম সে তখন প্রায় অচৈতন্য, এর ফলে তাকে সায়ানাইড ইনজেকশন দেওয়াটা খুব সহজ হয়ে গেলো। মৌমাছি ওড়ানোর ব্যাপারটা নিছক একটা ছেলেমানুষী ছাড়া আর কিছু নয়। তবু আগেই বলেছি, ছেলেবেলায় পড়া সেই কবিতা দেখছেন না খুনগুলো আগাগোড়া কেমন কবিতার ছন্দ ও নিয়ম মেনে হয়ে আসছে। তা এক্ষেত্রেই বা তার ব্যতিক্রম হতে যাবে কেন?
ঠিক এর পরেই, কি ঘটবে আমি আগেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম। আমি নিজেই সেরকম একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম, আমরা সবাই কঠোর অনুসন্ধান চালানোর কথা বললাম। আগেই আমি সেই রিভলবারটা লুকিয়ে রেখেছিলাম নিরাপদ জায়গায়। সায়ানাইড কিংবা ঘুমের ওষুধ কোনো কিছুই আমার কাছে আর ছিলো না।
এরপর আমি নিজে উদ্যোগ নিয়ে বলালম আর্মস্ট্রংকে, এখুনি আমরা আমাদের মতলবটা কার্যকর করতে চাই। ব্যাপারটা খুবই সহজ, আমি নিজেই হবো পরবর্তী শিকার। সম্ভবত তাতে খুনীর ওপর নজর রাখবো।
আর্মস্ট্রং খুব আগ্রহ দেখালো আমার সেই মতলবে। সেদিন সন্ধ্যায় অভিনীত হলো সেই অভিনব নাটক। কপালে সামান্য একটু লাল মাটির প্লাস্টার, একটা লাল পর্দা, এবং উলের একটা পোলো, তাতেই নাটক মঞ্চস্থ হলো। মোমবাতির মৃদু আলো বড় বেশী কাঁপছিল, এবং অনিশ্চিতও বটে, খুব কাছ থেকে যে আমাকে পরীক্ষা করবে, সে হলো ডঃ আর্মস্ট্রং।