বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে মরিসকে কাটিয়ে টনি দেখলো, সামনে যতদূর দৃষ্টি ফেলা যায় ফাঁকা নির্জন রাস্তা। বিনা বাধায় গাড়ি চালানো যাবে এবার। সঙ্গে সঙ্গে সে তার মার্স্টান গাড়ির গতি দিলো আর একটু বাড়িয়ে।
মরিস, গাড়িটা সেই থেকে জ্বালাচ্ছিল তাকে, গাড়ির গতি বাড়াবে না, আবার অন্যকে পথও ছেড়ে দেবে না কিছুতেই। পুরনো মডেলের গাড়িগুলোর ওপর এই সব সেকালে লোকদের কি যে দুর্বলতা! আরে বাবা তুমি না হয় পুরানো যা কিছু আঁকড়ে ধরে রাখতে চাও, কিন্তু তোমার ঐ শম্বুক গতি সম্পন্ন গাড়িটি যে অন্যের বিরক্তির কারণ হতে পারে এ কথাটাও কি ভেবে দেখেছ? দাও না বেচে গাড়িটা। আর কেনার কোন খদ্দের না থাকলে, পেট্রল ঢেলে দাও দেশলাই জ্বেলে, নিমেষে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। ল্যাটা চুকে যাক। ইংল্যাণ্ডের মানুষগুলো যেন কেমন। হাজার হাজার বছরের পুরনো ঝরঝরে বাতিল যোগ্য জিনিষগুলো নাকি তাদের কাছে একটা সম্ভ্রমের প্রতীক, অভিজাতের ছাপ আছে বলে চালিয়ে দিতে হবে। আজব ব্যাপার। কিন্তু ফ্রান্সে এমনটি হয় না। অনেক, অনেক ভাল ফ্রান্স, এদিক দিয়ে ফ্রান্স বহু যোজন এগিয়ে আছে ইংল্যাণ্ডের থেকে।
জায়গাটার নাম মেয়র। এখানেই গাড়ি থামিয়ে গলাটা একটু ভিজিয়ে নেওয়া যাক। গলা শুকিয়ে একেবারে কাঠ, আর গাড়ি চালানোই যাচ্ছে না। গাড়ির কলকজা ঠিক থাকলেও তার দেহের কলকজা বিগড়ে যেতে পারে। ঘড়ি দেখল, হাতে সময় আছে অনেক এখনো। শখানেক মাইল কিংবা তারও কিছু বেশি এখনো পাড়ি দিতে হবে তাকে। সামনেই ছিল একটা শুঁড়িখানা, টনির শুকনো মুখে জল নেমে এলো।
শুঁড়িখানায় গিয়ে ঢুকলো টনি গাড়ি থেকে নেমে। হুইস্কির ফরমাস দিলো সঙ্গে একটু বেশি করে বরফ দিতে বললো ওয়েটারকে। উঃ যা গরম। এমন গরম আবহাওয়া থেকে নিগার দ্বীপে গেলে দারুণ জমবে। শুঁড়িখানায় বসে একটু চিন্তা করার অবসর পেলো টনি। এখন সে ভাবছে ওয়েনদের কথা, এরা কারা? এরা যে টাকার কুমির, তাতে কোন সন্দেহ নেই। বেছে বেছে ওদের মতো বিত্তবানদের ঠিক খুঁজে বার করেছে বাড়গার। বেচারী। নিজে কপর্দকহীন হলে হবে কি, দুনিয়ার বড় বড় ধনী মহাজনদের হাঁড়ির খবর তার নখদর্পনে।
মনে হচ্ছে মদের বন্যা বইবে টেবিলে। টাকার কুমির অথচ মরায় আসক্তি, এ রকম বিচিত্র মানুষ তো চোখে পড়েনি আজ অবধি। আর সেই সঙ্গে যদি গ্যাব্রিয়েল টাকে পাওয়া যায় সেখানে, তাহলে তো আর বলার কিছু নেই। চিত্রতারকার সঙ্গে বলে কথা, দারুণ ব্যাপার। কিন্তু টাল যদি না থাকে? তাতে কিছু এসে যাবে না। আরে অতো বড় একটা প্রসাদে একটা দুটো মেয়েও থাকবে না, সেটা কি হয়।
শুঁড়িখানা থেকে বেরিয়ে এসে গাড়ির সামনে টনি তার শরীরটা সোজা-টান টান করে দাঁড়ালো, ঘুম পাচ্ছিল, হাই তুললো। ট্রাউজারের বকলসে ঝোলানো নীল চশমাটা টেনে নিয়ে চোখে পরলো। গাড়িতে উঠে ইঞ্জিন চালু করলো সঙ্গে সঙ্গে।
পথ চলতে গিয়ে কয়েকটি মেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে, তাদের শ্যেন দৃষ্টি তখন নিবদ্ধ টনির ওপর। ভাবছে তারা, এ আবার কে? কোন চিত্রতারকা টারকা। নাকি দেখতে সুপুরুষ। দীর্ঘদেহী এক মাথা কোকড়া চুল, বাদামী রঙ গায়ের, সব চেয়ে সুন্দর তার নীল গভীর দুটি চোখ। চিত্রতারকার সবকটি গুণ যেন মিশে আছে ছোকরাটির মধ্যে। কিন্তু কে এই যুবকটি?
গীয়ার বদল করে গাড়ি চালাতে শুরু করল মাস্টার্ন। নিমেষে গাড়ির গতিবেগ বাড়লো। তারপরেই কঁচা রাস্তা থেকে উঠে এলা পাকা রাস্তায়। তার গাড়ির প্রচণ্ড গতি দেখে পথচারীরা সরে দাঁড়িয়ে তার চলার পথ মসৃণ করে দিলো। তাদের সমীহ করার ধরন দেখে মৃদু হেসে গাড়ির গতি আরো বাড়িয়ে দিলো মার্স্টান, আশী থেকে এক লাফে একেবারে একশোতে। যেন সে জয়যাত্রায় মেতে উঠেছে। চলেছে কিছু একটা জয় করতে, কিন্তু সে জয় কিসের…আপাততঃ তা নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না সে। তার এক মাত্র লক্ষ্য এখন নিগার আইল্যাণ্ড।
মিঃ ব্লোরও সেই ট্রেনের যাত্রী, উঠেছেন তিনি প্লিমাউথ থেকে। কামায় তার একমাত্র সাহসী একজন পৌঢ়। নাবিকের মতো চেহারা ঘোলাটে চোখ তার। আশ্চর্য কি করতে পারে লোকটা। মুখ ব্যথা হয় না। যাই হোক, একটু আগে সে তার বকবকানী থামিয়েছে, ঘুমোচ্ছে ঘাড়-মুখ গুঁজে।
এই ফাঁকে পকেট থেকে একটা ছোট্ট নোটবই আর পেন্সিল বার করে কি যেন লিখলেন তিনি। লেখা বন্ধ করে স্বগোক্তি করলেন তিনি আমাকে বাদ দিয়ে বাকি কজন হলো এইরকম, এমিলি, ব্লেন্ট, ভেরা, ক্লেথন, ডঃ আর্মস্ট্রং, অ্যান্টনি মাস্টার্ন, বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ, জেনারেল ম্যাকআর্থার, ফিলিপ লম্বার্ড, মিঃ রগার্স ও তার স্ত্রী মিসেস রগার্স। শেষোক্ত দুজন একাধারে ভৃত্য এবং খানসামা।
নোটবই এবং পেন্সিল পকেটে চালান করে দিয়ে সামনের ঘুমন্ত ভদ্রলোকটির দিকে একবার আড়চোখে দেখে নিয়ে ভাবলেন তিনি, তাহলে আমাকে নিয়ে হলো মোট দশজন। চমৎকার জমবে…..
তারপর তিনি তাকালেন খোলা জানালাপথের দিকে–শুরু থেকে ভাবতে বসলেন ঘটনাটা, কাজটা তাহলে বেশ সহজ হবে বলেই মনে হচ্ছে। হঠাৎ কেন জানি না তার মনে হলো কে ঠিক চাকুরী প্রার্থী বলে মনে হচ্ছে তো। সন্দেহ নিরসন করার জন্য এগিয়ে গিয়ে বেসিনের আয়নাটায় নিজের চেহারাটা একবার দেখে নিলেন তিনি। কদিন দাড়ি-গোঁপ না কামানোর দরুন মুখটা বেশ ভারিক্কী দেখাচ্ছে। মুখে একটা মিলিটারী মেজাজ এসেছে। বাদামী চোখ হা, সব মিলিয়ে নিজেকে বেশ উপযুক্ত চাকুরী প্রার্থী বলেই মনে হচ্ছে, তাই না নিজের একজন মেজর বলেও চালিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু দলে যে একজনে মিলিটারী আছে, যদি ধরা পড়ে যাই তার কাছে, না থাক, অত বড় একটা ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না।