কোনো অপরাধ আর সেই অপরাধের শাস্তি সব সময় আমাকে মুগ্ধ করতো। সব রকমের গোয়েন্দা ও থ্রীলার গল্প পড়ে আমি উপভোগ করি। অবসর সময়ে নিজের ঘরে বসে একা একা বিচিত্র সব খুনের পরিকল্পনা করতাম।
তারপর যখন আদালতের আইন কার্যকর করার মহান দায়িত্ব আমার ওপর ন্যস্ত হলো, তখন আমার মনের সেই সুপ্ত পাশব প্রবৃত্তির আরো বেশী করে চরিতার্থ করার প্রেরণা পেলাম। বেচারা অপরাধী আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মৃত্যু ভয়ে কাঁপছে, বিচারকের মুখ থেকে তার আসন্ন মৃত্যুর পরোয়ানা শোনার জন্য বিচারকের মুখের দিকে গভীর আগ্রহ নিয়ে প্রতীক্ষা করে থাকার দৃশ্যটা দেখে আমি খুব মজা পেতাম। তবে মনে রাখবেন নিরপরাধ কোনো ব্যক্তিকে আসামীর কাঠগড়ায় দেখলে আমি কখনোই খুশী হতে পারতাম না। অন্তত এ ধরনের দুটি মামলার শুনানী মুলতুবি রেখে জুরিদের আমি বলেছি, আজ কোনো কেস নেই। যাই হোক, পুলিশের সততা এবং দক্ষতার জন্য আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই বেশীর ভাগ অপরাধী যাদের বিচারের জন্য আমার সামনে হাজির করা হতো, তারা সবাই দোষী সাব্যস্ত হয়।
এই রকমই একটা কে ছিলো এডওয়ার্ড সিটনের। লোকটার সুন্দর চেহারা এবং সুন্দর ভদ্র আচরণ জুরিদের ভুল পথে চালিত করে এবং প্রভাব ফেলে তাদের মনে। কিন্তু কেবল মাত্র সাক্ষ্য প্রমাণেই নয়, অপরাধ জগতে আমার দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, লোকটা সত্যি সত্যি অপরাধ করেছে, খুনী না হয়ে যেতে পারে না সে। তার বিরুদ্ধে আনা খুনের অভিযোগ মিথ্যে নয়, একজন বয়স্ক মহিলাকে খুন করে সে, যিনি বিশ্বাস করতেন তাকে।
ফাঁসুড়ে বিচারক হিসাবে আমার খ্যাতি বা দুর্নাম ছিলো একটা সে যাই হোক, মামলার সব দিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিচার করে তবেই আমি আমার শেষ রায় জানালাম, আমার বিচার ছিলো অত্যন্ত কঠোর, কোনো অপরাধীকেই আমি রেহাই দিতাম না। আমাদের অনুভূতিপ্রবণ, উকিল ব্যারিস্টারদের সওয়াল জবাবে জুরিরা যাতে বাধিক্যে কাতর না হয়ে পড়ে, কিংবা আসামী পক্ষের উকিল যাতে তাদের প্রভাবিত করতে না পারে, তার জন্য সব রকম চেষ্টা চালিয়ে যেতাম। এর জন্য আমি তখন প্রকৃত ঘটনা ও সাক্ষ্য প্রমাণের প্রতি জুরিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতাম, তাতে কাজ হতো, ওরা তখন আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠতো, তাদের স্বাভাবিক মতামত ব্যক্ত করতে, অপরাধীর মতামত ব্যক্ত করতো, অপরাধীর সম্পর্কে আইনের সুবিচার করতো।
বেশ কয়েক বছর থেকে নিজের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করি, নিজের প্রতি আস্থা, নিয়ন্ত্রণ সব যেন হারিয়ে ফেলছিলাম, তখন আমার কেবলি ইচ্ছা হতো, বিচারের প্রহসন ছেড়ে দিয়ে নিজের হাতে আইন তুলে নিতে, নিজের খুশিমত অপরাধীকে শাস্তি দিতে।
আজ আমি অকপটে স্বীকার করছি, আমি চেয়েছিলাম, নিজেই একটা খুন করি। এ যেন নিজেকে প্রকাশ করার জন্য, স্বীকৃতি লাভের জন্য শিল্পীর সেই চিরন্তন চাওয়া, চেস্টা করলে অপরাধ জগতে আমিও একজন শিল্পী হতে পারি। কিন্তু আমার সব জল্পনা কল্পনা অনুমান প্রচণ্ড ভাবে ধাক্কা খেলো আমার বিবেকের কাছে, আমার পেশার কাছে। বিচারকের কি খুনী হওয়া সাজে?
তবু মন মানে না। কেবলি তাগিদ খুন, হা খুন আমাকে করতেই হবে। তার থেকেও বড় কথা হলো, সে খুন যেন সাধারণ না হয়। সে খুন অবশ্যই যেন অদ্ভুত হয় একটু বিচিত্র ধরনের, সাধারণের থেকে একটু আলাদা রকমের। কিন্তু আমার বিবেক আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, ন্যায়বিচার যেন হয়। নিরপরাধ কেউ যেন অযথা শাস্তি না পায়।
তারপর হঠাৎ, হা হঠাৎই একদিন সেই খুনের পরিকল্পনাটা আমার মাথায় এলো। একজন চিকিৎসের সঙ্গে কথা হচ্ছিল আমার, একজন অনামী ডাক্তার কথায় কথায় বললো সে, এমন এক একটা খুন আছে, কোনো আইনই স্পর্শ করতে পারে না খুনীকে।
তার জানা একটা উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বললেন, হঠাৎ তার এক রোগিনী মারা গেলেন। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হতো তার। নিশ্বাসকার্য স্বাভাবিক করার ওষুধ নাকে শোঁকাতে গিয়ে একটু অবহেলা করার দরুনই এই মৃত্যু। ওষুধ দিয়েছিল এক দম্পতি, তারই দেখাশোনা করতো সেই বৃদ্ধা মহিলাটিকে। বৃদ্ধা মারা যাওয়ায় কিছু টাকা তারা পেয়েছে। কেবল মাত্র এই মোটিভকে কেন্দ্র করে তাদের দোষী হিসাবে চিহ্নিত করা যায় না। হয়তো অভিযোগ উঠতে পারে, ওষুধ শোঁকাতে গিয়ে একটু অবহেলা হয়ে গেছে, তা এমনতো হতেও পারতো তিনি নিজে খুঁকতে গিয়েও। এই অজুহাতেই রেহাই পেয়ে গেলো দম্পতিটি। আইনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেলেন তারা।
সেটাই হলো সমস্ত ব্যাপারটার সূত্রপাত। সহসা দেখতে পেলাম, আমার পথ পরিস্কার। আমি তখন বদ্ধপরিকর একটা খুন নয়, এক সঙ্গে অনেক অনেকগুলো খুন। ছেলেবেলায় সেই কবিতাটির কথা আমার মনে পড়ে গেল দশটি কালো নিগার ছেলের কবিতা।
শুরু হলো গোপনে অপরাধীদের সংগ্রহ করা…..
কি ভাবে সংগ্রহ করা হলো, সেই বিস্তারিত বলে অস্থা সময় নষ্ট করবো না। কারোর সঙ্গে দেখা হলে একটা নির্দিষ্ট রুটিন মাফিক কথাবার্তা বলার রেওয়াজ ছিলো আমার। এভাবে একটা বিস্ময়কর ফল পেয়ে গেলাম। নার্সিং হোমে থাকার সময় ডঃ আর্মস্ট্রং এর কেসটা পেয়ে গেলাম। যে নার্সাট আমার দেখাশোনা করতো, তার সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে সে আমায় খবর দিলো, ডঃ আর্মস্ট্রং ছিলো মাতাল, মদ্যপ। একদিন মাতাল অবস্থায় একজন রুগীকে অপারেশন করতে গিয়ে মেরে ফেলে সে। ব্যস পেয়ে গেলাম আর একজন অপরাধীর নাম।