তা সেটা কার ঘরের জানালা? সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার।
ভেরা ক্লেথর্নের। এখন স্যার, তাদের প্রত্যেকের ব্যাপারটা আলাদা আলাদা ভাবে বিশ্লেষণ করা যাক। প্রথমে ফিলিপ লম্বার্ড থেকে শুরু করছি। ধার নেওয়া যাক মিস ক্লেথনের ঘরের জানালা গলিয়ে পাথর ফেলে ব্লোরকে হত্যা করেছে লম্বার্ড। তারপর ভেরাকে ঘুমের পিল খাইয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করে তার গলায় ফাঁস লাগিয়ে দেয়। সবশেষে সমুদ্রতীরে গিয়ে নিজেই নিজেকে গুলিবিদ্ধ করে থাকবে।
কিন্তু তাই যদি হয়, তার কাছ থেকে রিভলবারটাই বা কে নিয়ে গেলো? কারণ প্রাসাদের দোতলায় ওয়ারগ্রেভের ঘরের ভেতরে রিভলবারটা পড়ে থাকতে দেখা যায়।
রিভলবারের ওপর কার হাতের ছাপ ছিলো?
হ্যাঁ, স্যার ভেরা ক্লেথর্নের।
কিন্তু লম্বার্ড তখনো জীবিত ছিলো–
স্যার, আপনি কি বলতে চাইছেন জানি, ভেরা ক্লেথই খুনী এই তো। লম্বার্ডকে গুলিবিদ্ধ করার পর রিভলবারটা হাতে নিয়ে প্রাসাদে ফিরে যায় সে, মার্বেল পাথরটা ব্লোর এর ওপর নিক্ষেপ করার পর নিজে সে তার গলায় ফাঁস লাগায়।
এই পর্যন্ত সব ঠিক আছে। তার শয়নকক্ষে একটা চেয়ারের ওপর শ্যাওলার ছাপ পাওয়া যায়, এবং তার জুতোতেও দেখে মনে হয়, সে তার গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়ার জন্য সেই চেয়ারটা ব্যবহার করে থাকবে। চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে গলায় ফাঁস লাগানোর কাজ শেষ হওয়ার পরেই পা দিয়েই চেয়ারটা সরিয়ে দেয় এবং ঝুলে পড়ে সে।
কিন্তু চেয়ারটা ছুঁড়ে ফেলার মতো অবস্থায় ছিলো না। অন্য সব চেয়ারগুলোর মতো সেই চেয়ারটাও সযত্নে দেওয়ালের পাশে হেলান দিয়ে রাখা ছিলো। ভেরা ক্লেথনের মৃত্যুর পরে সেই কাজটা অন্য কেউ করে থাকবে।
এরপর স্বভাবতই আমাদের সব সন্দেহ গিয়ে পড়ে ক্লোরের ওপর। তবে এর মধ্যেই একটা কিন্তু থেকে যায়, আপনি যদি বলেন, লম্বার্ডকে গুলি বিদ্ধ করে ভেরা ক্লেথর্নকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করার পর প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যায় সে, তারপর উঠোনে নেমে একটা ভারী মার্বেল পাথরের আঘাতে নিজেই নিজেকে হত্যা করেছে সে। সেক্ষেত্রে আপনার কথা আমি বিশ্বাস করবো না। আপনার এ যুক্তি আমি মেনে নিতে পারি না। কারণ পুরুষরা এভাবে কখনো আত্মহত্যা করতে পারে না। তাছাড়া সে ধরনের মানুষই ছিলেন না ব্লোর। ব্লোরকে আমরা বেশ ভালো করে জানি ন্যায় বিচার নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো লোক সে কোনদিনও ছিলো না।
এ ব্যাপারে, বললেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, আমি তোমার সঙ্গে একমত।
ইন্সপেক্টর মেইন তখন বলে, তাহলে স্যার, এর থেকে ধরে নেওয়া যেতে পারে, ঐ দ্বীপে নিঃশ্চয়ই অন্য আর কেউ তখন জীবিত ছিলো। সমস্ত ব্যাপারটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর যে কিনা সব কিছু ভালো করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে গেছে। কিন্তু এখন কথা হচ্ছে, এতো সব ঘটনা ঘটে যাওয়ার সময় কোথায় ছিলো সে, আর কোথায়ই বা যেতে পারে সে? অথচ স্টিকলহ্যাভেনের লোকেরা সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে, উদ্ধারকারী দল সেই দ্বীপে পৌঁছানোর আগে সেখানে থেকে কেউই চলে যেতে পারে না। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আবার থামলে সে এখানে।
সেক্ষেত্রে, জিজ্ঞেস করলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, কি হতে পারে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা দোলালো সে। তারপর সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বললো, কিন্তু সে ক্ষেত্রে কে, কে তাদের খুন করলো?
এমমা জেন জেলে ডিঙির মালিক স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে যে মূল্যবান নথিটি পাঠিয়েছিল সেটা এখানে তুলে ধরা হলো।
যৌবনের শুরু থেকেই আমি বুঝে গেছি, আমার প্রকৃতি রাশি রাশি বিতর্কে ভরা। তাহলে প্রথম থেকেই শুরু করি, সংশোধনের অসাধ্য একটা রোমান্টিক ভাবপ্রবণতা। এই যে বোতলবন্দী করে একটা অতি প্রয়োজনীয় নথি সমুদ্রে ফেলে দেওয়া, এর মধ্যে একটা অদ্ভুত রোমাঞ ছিলো, ভেতরের অভিযানের কাহিনী গুলো, যখন কেউ পড়বে তার সেই শিশুসুলভ মনোভাবটা কল্পনা করার মধ্যে একটা অন্য মাদকতা আমি অনুভব করতে পারছি। আমার মনে রোমাঞ জাগায় আর সেই কারণেই আমি অবলম্বন করি এই পন্থাটা স্বীকারোক্তি লেখা, সেটা বোতলবন্দী করা, পরে বোতলের মুখটা সীল করে সমুদ্রের ঢেউতে ভাসিয়ে দেওয়া। আমার ধারণা আমার এই স্বীকারোক্তি কারোর না কারোর হাতে গিয়ে পড়বে। (আবার নাও পড়তে পারে) এবং তারপর (কিংবা আমি কি নিজেই নিজের ঢাক পেটাচ্ছি?) মানুষ নিগার দ্বীরে সেই অনির্ণীত হত্যা রহস্যের ব্যাখ্যা খুঁজে পাবে।
রোমান্টিকতার সঙ্গে আরো একটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমি জন্মাই। মৃত্যু দৃশ্য দেখা কিংবা মৃত্যু ঘটানোর মধ্যে অবশ্যই আমার একটা পাশব প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার প্রবণতা ছিলো, সেই নিষ্ঠুরতার মধ্যে একটা অদ্ভুত রোমা অনুভব করতাম আমি তখন। মনে আছে ছেলেবেলায় বাগানের পোকা মাকড় মেরে দারুণ মজা পেতাম। সেই ছেলেবেলা থেকেই খুনের নেশায় পেয়ে বসলো আমাকে।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটা বৈপরীত্যও এসে ভর করলো আমার সেই খুনের নেশার মধ্যে। ন্যায় বিচারের একটা বলিষ্ঠ প্রবণতা দেখা দিলো। নিরপরাধ ব্যক্তি আমার হাতে প্রাণ হারাবে, এ যেন ভাবাই যায় না। সব সময় আমার চিন্তা ছিলো সত্যিকারের দোষী ব্যক্তির যেন শাস্তি হয়।
আমার মনে হয়, একজন মনস্তত্ববিদ ঠিক বুঝতে পারবে, আমার মানসিকতা ঠিক কিরকম ছিলো সেই সময়। আর সেই মানসিকতাই কি পরবর্তী কালে আইনকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করতে সাহায্য করেছিল আমাকে। নিজেকে একজন পেশাদার আইনজ্ঞ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরে সহজাত প্রবৃত্তির দিক থেকে যথেষ্ট সন্তুষ্ট হলাম।