কেশো গলা পরিস্কার করে বললো মেইন, ভালো কথা স্যার, ব্যাপারটা আসলে ঠিক সেই রকম নয়। একজন বিকারগ্রস্ত লোক নিজের হাতে বিচারের ভার তুলে নিলো। আইনের চোখে ধরা ছোঁয়ার বাইরে এমনি দশজন লোককে সংগ্রহ করে সে তারা প্রকৃত অপরাধী নাকি নিরপরাধ, তাতে কিছু এসে যায় না।
স্থির চোখে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বললেন লেগ, তাই নয় কি? আমারো তাই মনে হয়–
চুপ করে গেলো মেইন। সম্মান দেখানোর জন্য তামাশা করতে থাকলো সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়লেন লেগ।
বলে যাও বললেন তিনি এক মিনিট, ভাবলাম বুঝি বা কোনো ক্ল পেয়ে গেলাম। হারিয়ে গেলো সেটা, বলল, কি যেন বলেছিলে তুমি?
মেইন আবার বলতে শুরু করলো, ধরে নেওয়া যাক, দশজন লোকের বিচার হওয়ার কথা ছিলো। ইউ. এন. ওয়েন তার কাজ শেষ করে যে ভাবেই তোক সেই দ্বীপ থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়ে থাকবে।
এ যে দেখছি চমৎকার ভোজবাজির খেলা। কিন্তু তুমি তো জানো মেইন, এর একটা ব্যাখ্যা থাকা চাই, যুক্তি থাকা চাই।
স্যার আপনি হয়তো ভাবছেন, লোকটা যদি দ্বীপে না গিয়েই থাকে তাহলে তার সেই দ্বীপ থেকে তার উধাও হয়ে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। অথচ সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেই দ্বীপে আদৌ সে যায় নি। অতএব এর একমাত্র ব্যাখ্যা হলো, খুনী ঐ দশজনের মধ্যেই একজন।
মাথা নাড়লেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার। আন্তরিক ভাবে বলতে থাকে মেইন
হ্যাঁ, সে কথাও আমরা ভেবেছি স্যার। আমরা এর গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছি। শুরুতেই বলে রাখি, নিগার দ্বীপে ঠিক কি ঘটেছিল, এ ব্যাপারে আমরা একেবারে অন্ধকারে পড়ে নেই। ভেরা ক্লেথর্ন ডায়েরী লিখতো এবং এমিলি ব্লেন্টও। বৃদ্ধ ওয়ারগ্রেভ কিছু নোট লিখে যায়-রসক ঘীন, আইন মাফিক, রহস্যজনক, তবে যথেষ্ট সহজবোধ্য। এবং ব্লোরও কিছু নোট লিখে ছিলো। তবে এই সব ডায়েরী ও নোটের অথ্যগুলোর মধ্যে মোটামুটি ভাবে মিল আছে একটার সঙ্গে একটার। মৃত্যুগুলো হয়েছিলো এই ভাবে, মার্স্টান, মিসেস রগার্স, ম্যাকআর্থার, রগার্স, মিস ব্লেন্ট, ওয়ারগ্রেভ। ভেরা ক্লেথনের ডায়েরী থেকে আমরা জানতে পারি, রাতের অন্ধকারে প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে যায় আর্মস্ট্রং তারপর তাকে অনুসরণ করে ব্লোর ও লম্বার্ড তার খোঁজে। ব্লোরের নোটবইতে একটা নোট লেখা ছিলো, স্রেফ দুটি অক্ষরে-আর্মস্ট্রং নিরুদ্দেশ।
স্যার, এখন সব দিক বিবেচনা করে এর থেকে মনে হয়, এখানে আমরা একটা ভালো সমাধান খুঁজে পেতে পারি। আপনার মনে আছে, জলে ডুবে মারা যায় আর্মস্ট্রং। ধরে নিলাম, আর্মস্ট্রং তখন পাগল হয়ে যায়–হওয়ারই তো কথা, সবাইকে অমন নৃশংস ভাবে খুন করলেও কারোরই বা মাথার ঠিক থাকে বলুন। আর আর্মস্ট্রং খুনী হলেও সেও তো রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। তাই মাথা ঠিক না থাকার ফলে বিবেকের দংশনে পাহাড়ের চুড়া থেকে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে থাকবে, কিংবা সমুদ্রে সাঁতার কেটে সে তার দেশে পালিয়ে আসতে গিয়ে গভীর জলে তলিয়ে গিয়ে থাকবে। আর তাতেই তার মৃত্যু ঘনিয়ে এসে থাকবে।
সমাধানের সূত্রটা ভালো, কিন্তু ধোপে টিকবে না। না, স্যার তা হয় না। প্রথমেই পুলিশ সার্জেন্টের সাক্ষ্য দেখুন। ১৩ই আগস্টের সকালে সেই দ্বীপে গিয়ে হাজির হয় সে। আমাদের সাহায্যে লাগাতে পারে এমন বিশেষ কোনো তথ্য আমরা দেখতে পাই না। তার রিপোর্টে তার বলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তাদের সবার মৃত্যু ঘটে কম করেও অন্তত ছত্রিশ ঘণ্টার মধ্যে। তবে আর্মস্ট্রং সম্পর্কে একেবারে নিশ্চিত সে। সে বলেছে, আর্মস্ট্রং এর দেহ জলে ভেসে যাওয়ার আগে আট দশঘণ্টা জলের মধ্যে ছিলো সে। এর থেকে এখন ধরে নেওয়া যেতে পারে রাত দশটা এগারোটার সময় প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গিয়ে থাকবে আর্মস্ট্রং, কেন এমন হলো। দেহটা যেখানে ভেসে যায়, সেই জায়গাটা আমরা দেখেছি দুটো পাথরের মাঝখানে মৃতদেহটা আটকে গিয়ে থাকবে, সেখানে তার পোষাকের কিছু অংশ, চুল ইত্যাদি ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ১১ তারিখের রাত এগারোটা নাগাদ মৃতদেহটা নিশ্চয়ই সেখানে ভেসে এসে থাকবে সামুদ্রিক ঝড়ের টানে। তারপর ঝড় থেমে যায়, সমুদ্রের উত্তাল ঢেউও তখন শান্ত স্তিমিত, আর জলও তখন সমুদ্র তীর থেকে অনেক নিচে নেমে গিয়ে থাকবে।
আপনি হয়তো বলতে পারেন, এটা আমার ধারণা, সমুদ্রে যাওয়ার আগে তিনজনকে শেষ করে গিয়ে থাকবে আর্মস্ট্রং। কিন্তু তা নয় এই যুক্তিতে যে, সমুদ্রের ধার থেকে আর্মস্ট্রং এর মৃতদেহ অশান্ত সমুদ্র থেকে টেনে তুলে নিয়ে আসা হয় ওপরে। নরম বালির ওপর তার মৃতদেহ টানাটানির স্পষ্ট দাগ আমরা দেখেছি বালির ওপর। অতএব একটা ব্যাপারে আমি একেবারেই নিশ্চিত, আর্মস্ট্রং এর মৃত্যুর পর একজন কিংবা দুজন অবশ্যই জীবিত ছিলো তখন।
একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলো সে; আর এর থেকে ঠিক কি মনে হয় জানেন স্যার ১১ তারিখের সকালের অবস্থা এইরকম–আর্মস্ট্রং নিরুদ্দেশ (জেলে ডুবে যায়)। তখনও তিনজন লোক বেঁচে ছিলো; লম্বার্ড, ব্লোর এবং ভেরা ক্লেথর্ন। লম্বাৰ্ড গুলিবিদ্ধ, তার মৃতদেহ আর্মস্ট্রং এর কাছে সমুদ্রের ধারে পড়ে ছিল। ভেরা ক্লেথর্নকে তার শয়নকক্ষে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলতে দেখা যায়। ব্লোর এর মৃতদেহ উঠানে পড়ে থাকত দেখা যায়, তার মাথাটা থেঁতলানো ভারী পাথরের আঘাতে হবে হয়তো, আর পাথরটা যে ওপরের জানালা গলিয়ে ফেলা হছেছিল সেটা অনুমান করে নেওয়ার স্বপক্ষে যথেষ্ট যুক্তি আছে।