নিজের মনে হাসলো সে। প্রাসাদের মধ্যেও যেন একটা অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করছিলো।
সাধারণত, ভাবলো ভেরা, যেখানে প্রতিটি ঘরে মৃতদেহ পড়ে রয়েছে, প্রাসাদে সে ছাড়া অন্য কোনো জীবিত প্রাণীর অস্তিত্ব নেই, সেখানে কেউ ঘুমোতে চায় না, যদি মৃত্যু এসে বলে এবার তোমার পালা……।
রান্নাঘরের দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো সে। টেবিলের মাঝখানে তখনো তিনটি পুতুল পড়েছিলো। হাসলো সে। নিজের মনেই বললো সে, মহাকালের সময় থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছে তোমরা।
টেবিলের ওপর থেকে দুটি পুতুল তুলে নিয়ে জানালা গলিয়ে বাইরে ফেলে দিলো সে। উঠানের পাথরের মেঝের ওপর শব্দ হতে শুনলো।
আমার সঙ্গে তোমরা আসতে পারো। প্রিয়, আমরা জিতে গেছি। আমরা জয়ী। বিড়বিড় করে নিজের মনে বললো সে।
দিনের আলো নিভে আসছে একটা আবছায়া অন্ধকারে ডুবেছিলো ঘরটা।
ভেরা, খুদে নিগারটা তার হাতে তালি দিলো তারপর সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলো সে ধীরে ধীরে, কারণ হঠাৎ তার পা দুটো ভীষণ ক্লান্ত বলে মনে হলো।
একটা খুদে নিগার ছেলে একা থেকে গিয়েছিলো। কি করে শেষ হলো সেটা? ওহো, হা বিয়ে করে সে আর তারপর কেউ আর সেখানে ছিলো না…….।
বিবাহিত…মজার ব্যাপার, আশ্চর্য, হুগো যে সেই প্রাসাদে ছিলো, এ অনুভূতি কি করেই বা তার হলো……..?
অত্যন্ত বলিষ্ঠ তার সেই অনুভূতিটা। হা ওপর তলায় তার জন্য অপেক্ষা করছে হুগো। নিজেই নিজেকে বললো ভেরা, বোকামো করো না। তুমি এখন এমনি এতোই ক্লান্ত যে, যতো সব উদ্ভট চিন্তা এখন তোমার মনে জাগছে। এ সবই তোমার কল্পনা, এতটুকু মিল নেই বাস্তবের সঙ্গে।
ধীরে ধীরে উপরে উঠে চলে সে। সিঁড়ির একেবারে শেষ ধাপে উঠে আসার পর তার হাত থেকে কি যেন একটা পড়ে গেলো। রিভলবারটা যে তার হাত থেকে পড়ে গেলো নজরেই পড়লো না তার। তার লক্ষ্য এখন কেবল তার হাতের পুতুলটা, সেটাই এখন তার একমাত্র সঙ্গী, তার একাকীত্ব ঘোচানোর প্রতিকী।
প্রাসাদটা কি ভীষণ শান্ত। তবু, একেবারে ফাঁকা প্রাসাদ বলেও মনে হলো না….।
উপর তলায় তার জন্য অপেক্ষা করছে হুগো…।
একটা ছোট্ট, কালোমানিক এখনো অবশিষ্ট। সেই কবিতার শেষ লাইনটা কি যেন ছিলো? বিবাহিত হওয়া কিংবা সেই রকম কিছু একটা ব্যাপারে, তাই কি?
অবশেষে তার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো সে। ঘরের ভেতরে তার জন্য হুগো যে অপেক্ষা করছে। এ ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত সে। দরজা খুললো সে। হাঁপাচ্ছে সে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো ভেরা….।
ওটা কি ঘরের ছাদ থেকে কি যেন ওটা ঝুলছে? দড়ির শেষ প্রান্তে একাট ফাস আগে থেকেই তৈরী? এবং নিচে একটা চেয়ার? উঠে দাঁড়াবার জন্য। চেয়ারটা লাথি মেরে সরিয়ে দেওয়া যাক।….. আর সেটাই তো চেয়েছিলো হুগো…হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে সেটাই তো কবিতার শেষ তিনটি লাইন….
শেষ কালো মাণিক, শেষ প্রাণের কোনো,
মনের দুঃখে দিল গলায় দড়ি,
বাকী রইলো না আর কেউ……।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার হাত থেকে পড়ে গেলো পুতুলটা। মাটিতে পড়ে গড়াতে গড়াতে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। যন্ত্রচালিতের মতো সামনের দিকে এগিয়ে চললো ভেরা। এখানেই শেষ ঠাণ্ড, ভিজে হাতটা অবশ্যই সিরিলের, তার কণ্ঠনালী স্পর্শ করলো।
তুমি এখন ঐ পাহাড়টার কাছে যেতে পারো সিরিল।…..
এইভাবেই খুনটা সংগঠিত হয়েছিলো, কতোই না সহজ ছিলো সেই খুন। কিন্তু তারপর থেকেই স্মরণ করতে চেষ্টা করলো সেদিনের সেই ঘটনাটা…
আর নয়। সামনেই মৃত্যুর হাতছানি….
বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে চেয়ারের ওপরে উঠে দাঁড়ালো সে। ঘুমের ঘোরে, হাঁটার মত আধবোজা চোখে ছাদের দিকে তাকালো সে।…আশ্চর্য, তার হাত একটুও কাঁপলো না দড়ির ফাঁসটা নিজের গলায় পরিয়ে দিতে গিয়ে।
ঐ তো হুগো ওখানে দাঁড়িয়ে দেখলো, সে কি করলো, তাকে কি করতে হলো।
তারপর লাথি মেরে সে তার পায়ের তলা থেকে চেয়ারটা সরিয়ে দিলো……
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার স্যার টমাস লেগ উত্তেজিত হয়ে বললেন সমস্ত ব্যাপরটাই অবিশ্বাস্য।
জানি স্যার, শ্রদ্ধার সঙ্গে বললো ইন্সপেক্টর মেইন।
অ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার বলে চলেন, একটা দ্বীপে দশ দশটা মানুষ মারা গেলো, আর একজনও কেউ জীবিত রইলো না, আমার মাথায় কিছুই আসছে না।
অবিশ্বাস্য হলে, জোর দিয়ে বললো ইন্সপেক্টর মেইন, এটাই ঘটনা স্যার।
ও সব কথা রাখো। তেমনি উত্তেজিত হয়ে বললেন স্যার টমাস, কেউ না কেউ নিশ্চয়ই তাদের খুন করেছে।
সেটাই তো আমাদের সমস্যা স্যার।
ডাক্তারের রিপোর্ট থেকে কোনো হদিশ পাওনি?
না স্যার। ওয়ারগ্রেভ আর লম্বাৰ্ড গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। মিস ব্লেন্ট ও মার্স্টান মারা গেছে সায়নাইডের তীব্র বিষক্রিয়ায়। আর মিসেস রগার্স মারা গেছে অতিরিক্ত ঘুমের পিল খেয়ে, রগার্সের মাথাটা তার ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন। ব্লোরের মাথাটা কোনো ভারী জিনিসের আঘাতে থেতলে গেছে। জলে ডুবে মারা গেছে আর্মস্ট্রং। পিছন থেকে কোনো ভারী জিনিসের আঘাতে ম্যাকআর্থারের মাথার খুলি ভেঙ্গে যায়। আর তাতেই তার মৃত্যু হয়। আর সব শেষে গলায় দড়ির ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে থাকবে ভেরা ক্লেথর্ন।
যতো সব নোংরা ব্যাপার। মিনিট দুই চুপ করে থেকে উত্তেজিত স্বরে আবার বলে উঠলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, তার মানে তুমি বলতে চাও, স্টিকলহ্যাভেনের লোকজনেদের কাছ থেকে কোনো সাহায্যই পাওনি তুমি? খোঁজ নিয়ে দ্যাখো, তারা নিশ্চয়ই কিছু না কিছু জানে।