পাল্টা প্রশ্ন করলো ভেরা, কেন হবেনা? তোমার কোনো দয়া মায়া নেই?
উত্তরে বললল লম্বার্ড, তোমার জন্য আমার কোনো দয়া হয় না। আশাও করো না তুমি?
মৃতদেহটার দিকে আবার তাকালো ভেরা, ওর দেহটা জল থেকে আমাদের সরিয়ে দিতেই হবে। এসো, দুজনে আমরা ধরাধরি করে প্রাসাদ পর্যন্ত নিয়ে যাই।
কি দরকার? যেখানে আছে, নিশ্চিন্তে তাকে থাকতে দাও সেখানে।
যে ভাবেই হোক, তাকে তুলতেই হবে সমুদ্র থেকে।
হাসলো লম্বার্ড। ঠিক আছে, তুমি যা মনে করো–
নিচু হয়ে আর্মস্ট্রং-এর মৃতদেহে হাত দিলো সে। তাকে সাহায্য করার জন্য তার গায়ের ওপর ঝুঁকে পড়লো ভেরা। ভেরা তার সর্বশক্তি দিয়ে মৃতদেহটা তুলে ধরতে সাহায্য করলো লম্বার্ডকে।
জল থেকে ওপরে উঠাতেই হিমসিম খেয়ে গেলো লম্বার্ড। কাজটা খুব সহজ নয়।
যাই হোক, জল থেকে সমুদ্রতীরে মৃতদেহটা তুললো তারা কোনো রকমে। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভেরার দিকে তাকালো সে তুমি এখন সন্তুষ্ট তো?
হ্যাঁ যথেষ্ট বললো ভেরা।
ভেরার কথা বলার ধরণটা তাকে সতর্ক করে দিলো। ঘুরে দাঁড়ালো সে। এমন কি সে তার পকেটে হাত ঢোকাতেই টের পেয়ে গেলো, পকেট ফাঁকা, রিভলবার উধাও।
ভেরা তখন তার কাছে থেকে এক কিংবা দুগজ দুরে সরে গিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলো, হাতে রিভলবার।
মাথা নাড়লো ভেরা। শক্ত হাতে রিভলবারটা চেপে ধরলো সে। ফিলিপ লম্বার্ডের শিয়রে মৃত্যু। এর আগে কখনো এতো কাছে আসেনি মৃত্যু। আর এখনো পর্যন্ত হারও হয়নি তার।
হুকুম করার ভঙ্গিতে বললল লম্বার্ড, রিভলবারটা আমাকে ফেরত দাও। বলছি ফেরত দাও–
হাসলো ভেরা, তাচ্ছিল্যের হাসি।
এসো, আবার বললো লম্বার্ড, কাছে এসে রিভলবারটা আমার হাতে তুলে দাও বলছি।
ভেরাকে চুপ করে থাকতে দেখে তৎপর হলো লম্বার্ড, তার মস্তিষ্ক দ্রুত কাজ করে চলে। কথায় তাকে ভোলানো আর যাবে না, এখন কাজ, শুধু কাজ। কোন পথে, কি ভাবে এখন তার ভাবনা সেটাই। সারাটা জীবন ঝুঁকি নিয়ে এসেছে সে, সেই ঝুঁকিই নিলো সে এখানে।
শেষবারের মতো চেষ্টা করলো সে। ধীরে ধীরে শান্ত সংযত গলায় তাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলো, শোনো খুকী, মন দিয়ে আমার কথা শোনো–এবং তারপর হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠলো সে, কালো চিতার মতো, যেমন করে হিংস্র পশু ঝাঁপিয়ে পড়ে তার শিকারের ওপর।
আর তখনি রিভলবারের ট্রিগারটা টিপে ধরলো ভেরা যন্ত্রচালিতের মতো………।
নিশ্চল মুর্তির মতো লম্বার্ডের দেহটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক মুহূর্তের জন্যে, তারপর ভারি জিনিস পতনের মতো তার দেহটা পড়ে গেলো মাটির ওপর।
অতি সন্তর্পণে এগিয়ে গেলো ভেরা, হাতে তখনো তার সেই রিভলবারটা, সাবধানের মার নেই। কিন্তু অতো সাবধান হওয়ার প্রয়োজন ছিলো না।
ফিলিপ লম্বার্ড এখন মৃত। গুলিটা গিয়ে বিদ্ধ হয়েছিলো তার ঠিক হৃৎপিণ্ডে।
বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো ভেরা–এখন সে মুক্ত, স্বস্তি পেতে পারে, এখন মৃত্যু তাড়া করে ফিরবে না। অবশেষে সব ভয় কেটে গেলো।
আর ভয় নেই–তার নার্ভ ফেল করার কোনো কারণ আর রইলো না..।
দ্বীপে সে এখন একা, নিঃসঙ্গ, আর সঙ্গে আছে নয়টি মৃতদেহ। কিন্তু তাতেই বা কি এসে যায়? সে তত বেঁচে আছে…
বসলো সেখানে সে অত্যন্ত সুখে, অপার শান্তি বিরাজ করছে এখন তার সামনে…….কোনো ভয় নেই আর…..
সূর্য তখন অস্ত যেতে শুরু করেছে। লাল আভায় রাঙ্গায়িত পশ্চিম দিগন্ত। ভেরা তখন চলতে শুরু করলো। একটু আগের সেই ঘটনার আকস্মিকতায় চলার শক্তিটুকু যেন হারিয়ে ফেলেছিলো সে। তবে এখন সে অনেকটা নিশ্চিন্ত, নিজের নিরাপত্তা নিজে অর্জন করার আনন্দে বুঝি বা উজ্জীবিত।
এখন তার মনে হলো, খুব ক্ষুধার্ত, ঘুমও পাচ্ছে। সে এখন চায়, প্রাসাদে ফিরে গিয়ে ক্লান্ত শরীরটাকে তার বিছানায় এলিয়ে দেয়, তারপর শুধু ঘুম আর ঘুম……।
সম্ভবত আগামীকাল তারা আসবে এবং তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, এখানে থাকার জন্য তার কোন চিন্তাই নেই। এখন তার আর এই নিঃসঙ্গতা খারাপ লাগছে না। ওঃ এই নিবিড় একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতার মধ্যেই শান্তির পরশ অনুভব করতে পারছে। এটাই বোধহয় ঈশ্বরের আশীর্বাদ, একান্ত কাম্য ছিলো তার। চলতে চলতে এক সময় প্রাসাদের সামনে এসে ভালো করে তাকালো। এখানে এখন আর কোনো ভয় নেই, মৃত্যুর আশঙ্কা নেই। কোনো আততায়ী তার জন্য ওঁৎ পেতে বসে নেই এখানে। এখন নির্ভয়ে প্রাসাদের দিকে তাকিয়ে দেখতে পারে সে। অথচ একটু আগেও দিবালোকে এই প্রাসাদের দিকে ভালো করে তাকাতে পারেনি এক অজানা আশঙ্কায়, অজানা ভয়ে।
ভয়-ভয় জিনিসটা কেমন যেন অদ্ভুত…..।
যাইহোক, ভয়ের পর্ব এখন শেষ। ভয়টাকে সে জয় করেছে, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে তার থেকে দ্বিগুণ শক্তিধর একজন পুরুষকে ঘায়েল যে সে করতে পেরেছে, এ জয়ের আনন্দ এখন তার কাছে সব চেয়ে বেশী বলে মনে হলো।
প্রাসাদের ভেতরে এগিয়ে চললো সে। অস্তগামী পাকা টমাটোর মতো লাল সূর্যটা তখন পশ্চিমের আকাশটাকে লাল ও কমলা রঙে রাঙ্গিয়ে তুলেছিলো। তার মধ্যে একটা সুন্দর শান্তির স্পর্শ অনুভব করলো সে।
সমস্ত জিনিসটাই হয়তো একটা স্বপ্ন ভাবলো ভেরা।
ক্লান্ত ভয়ঙ্কার ক্লান্ত সে এখন। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে প্রচণ্ড ব্যথা যন্ত্রণা, চোখের পাতাগুলো বুজে আসছে। এখন আর ভয়ের কোনো চিন্তা নেই, নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে সে।