সে নিশ্চয়ই আগে থেকেই একটা গোপন আস্তানা ঠিক করে রেখেছিলো।
পুরনো প্রাসাদ হলে তবু কথা ছিলো।
তবু তারই মধ্যে যে তার লুকোবার জায়গাটা ঠিক করে নিয়ে থাকবে।
বেশ তো, লম্বার্ড বলে, সেই জায়গাটা আমি দেখতে চাই।
মৃদু চিৎকার করে উঠলো ভেরা, হ্যাঁ তা তো তুমি দেখবেই। আর কথাটা সে ও জানে বৈকি। সেখানে সে অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।
পকেট থেকে রিভলবারটা অর্ধেক বার করে লম্বার্ড বলে, জানো, এটা এখনো আমার সঙ্গে আছে।
আর্মস্ট্রং এর থেকে ব্লোর, অনেক বেশী শক্তি ধরে, তুমিই তো বলেছিলে, দৈহিক শক্তি অবশ্যই ব্লোর এর ছিলো, অন্তত তাকে দেখে সেই রকমই তো মনে হতো। কিন্তু কেন বুঝতে চাইছে না, আসলে আর্মস্ট্রং উন্মাদ। একটা বদ্ধ পাগল। আর জানো তো পাগলরা সব সময় সুস্থ মানুষের থেকে শক্তিধর, সেটাই তাদের বাড়তি সুবিধে।
রিভলবারটা পকেটে আবার চালান করে দিয়ে লম্বার্ড বলে, তাহলে চলো।
অবশেষে বললো লম্বার্ড, রাত নামলো আমরা কি করবো। ভেবেছো কিছু?
উত্তর দেয় না ভেরা। লম্বার্ড নিজের থেকেই আবার জিজ্ঞেস করলো, সে কথা ভাবোনি তুমি?
অসহায়ার মতো বললো ভেরা, কিই বা করতে পারি আমরা? হে ঈশ্বর ভীষণ ভয় করছে আমার?
বেশি চিন্তা ভাবনা করেই বললো লম্বার্ড চমৎকার আবহাওয়া, চাঁদ উঠবে। পাহাড়ের চুড়ায় একটা নিরাপদ জায়গা খুঁজে নিতে হবে। সেখানে বসে রাতটা কাটিয়ে দিতে হবে। কেউ যদি আমাদের দিকে এগিয়ে আসে, আমি তাকে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করবো।
থামলো সে। তারপর ভেরার দিকে ভালো করে তাকাতে গিয়ে বললো সে, ইস তোমার অমন হাল্কা পোষাকে ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে ভেরা?
ভেরার ঠোঁটে রহস্যময় হাসি। ঠাণ্ডা? মরে গেলে তো আরো বেশী ঠাণ্ডা হয়ে যাবে আমার শরীরটা।
হ্যাঁ, সে কথা সত্যি……শান্ত গলায় বললো লম্বার্ড। অস্থির ভাবে নড়েচড়ে উঠলো ভেরা।
এখানে আর বেশিক্ষণ বসে থাকলে সত্যি সত্যি আমি পাগল হয়ে যাবো। চলো এবার এগিয়ে যাওয়া যাক।
ঠিক আছে, চলো।
সমুদ্রের ধার দিয়ে উঁচু-নিচু পথ ধরে পাশাপাশি হেঁটে চললো তারা। পশ্চিম দিগন্তে সূর্য তখন ঢলে পড়তে শুরু করেছে। অপরাহ্নের সোনালী রোদটা কেমন যেন ম্লান বিষণ্ণ বলে মনে হলো।
হঠাৎ সমুদ্রের ঢেউগুলো গুণতে গিয়ে আক্ষেপ করে ভেরা বললো, দুঃখের কথা, সমুদ্রে স্নান করতে পারলাম না আমরা।
ফিলিপ তখন সমুদ্রের ধারে গভীর মনোযোগ সহকারে কি যেন নিরীক্ষণ করছিলো। হঠাৎ দ্রুত বলে উঠলো সে, ওখানে ওটা কি দ্যাখো তো? ঐ যে ঐ বড় পাথরটার কাছে?
স্থির চোখে সেদিকে তাকিয়ে বলে উঠলো ভেরা, কার যেন পোক বলে মনে হচ্ছে।
স্নানার্থী? হাসলো লম্বার্ড। মনে হয় সমুদ্রের কোনো জঞ্জাল টঞ্জাল কিছু হবে।
চলো, দেখাই যাক না জিনিসটা কি।
কাছেই যেতেই বলে উঠলো লম্বার্ড, তোমার অনুমানই ঠিক, ওগুলো কারোর পোষাকই বটে। আবার দেখছি, একজোড়া বুট জুতোও পড়ে রয়েছে। চলো, আর একটু তলিয়ে দেখা যাক।
সেই পাথরটার দিকে এগিয়ে চললো তারা। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বললো ভেরা, আরে এ তো শুধু পোষাক নয়, পোষাকের আবরণে এ তো একজন মানুষ……
পাশাপাশি দুটি পাথরের মধ্যে পড়েছিলো লোকটা, ঢেউ-এর ধাক্কায় ভাসতে ভাসতে লোকটা বোধ হয় ঐ পাথর দুটির মাঝখানে আটকে পড়ে গিয়ে থাকবে।
এক সময় সেখানে গিয়ে হাজির হলো লম্বার্ড এবং ভেরা। হাঁটু মুড়ে ঝুঁকে পড়লো তারা। মুখে তার এক বিন্দু রক্তও ছিলো না, ফ্যাকাশে বিবর্ণ, জলে ডোবা মুখ, ফুলে ঢোল।
আর্ত চিৎকার করে উঠলো লম্বার্ড, হায় ঈশ্বর। এ যে দেখছি আর্মস্ট্রং…….।
.
১৬.
হঠাৎ সময়টা যেন থমকে দাঁড়ালো।…স্তব্দ মহাজাগতিক, সব কিছু যেন নিস্তব্দ। সময়ের চাকাটাও আর ঘুরছে না…..স্থির। অচল……যেন হাজার হাজার বছরের পথ চলার ক্লান্তিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে পথের ধুলোয়।
না, সেটা কেবল মাত্র একটা কিংবা সেরকম কিছু…..
হাসি হাসি মুখ লম্বার্ডের। বললো সে, তাহলে শেষ পর্যন্ত, এই দাঁড়ালো, তাই না ভেরা?
উত্তর ভেরা বললো, এই দ্বীপে তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ রইলো না….।
বলাবাহুল্য। বললল লম্বার্ড, অতএব আমরা এখন জেনে গেছি, আমরা, এখন কোথায় তাই নয় কি?
তা সেই শ্বেতপাথরের ভল্লুকের কায়দাটা কি ভাবে কাজে লাগালে?
প্রিয়তমা, কায়দাটা অতি সহজ আর অত্যন্ত ভালোও বটে….
তাদের চার চোখের মিলন হলো আবার।
নিজের মনে ভাবলো ভেরা, আগে কেন আমি তার মুখটা ঠিক মতো চিনতে পারি নি? একাট নেকড়ে হা উপমাটা ঠিক তাই একটা নেকড়ে মুখ …তার সেই ভয়ঙ্কর দাঁতগুলো……।
মুখ খুললো লম্বার্ড, কর্কশ তার কণ্ঠস্বর বুঝি বা বিপজ্জনকও বটে তবে অর্থপূর্ণ।
এখানেই সব শেষ, বুঝলে।
আমরা এখন সত্যের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি। আর এখানেই শেষ…..।
হ্যাঁ, আমিও তা বুঝেছি শান্ত ভাবে বললো ভেরা।
তারপর স্থির চোখে সমুদ্রের দিকে তাকালো সে। জেনারেল ম্যাকআর্থারও স্থির চোখে তাকিয়েছিলো সমুদ্রের দিকে। কখন, কেবল গতকালই?
কিংবা তার আগের দিন? সেও বলেছিলো, এখানেই সব শেষ…..।
কিন্তু ভেরার কাছে সেই কথাগুলো, সেই ভাবনাগুলো বিদ্রোহ জানালো তার মনে। না, এ কখনোই শেষ হতে পারে না।
নিচে সেই মৃত লোকটির দিকে তাকালো ভেরা। বললো সে বেচারা ডঃ আর্মস্ট্রং…..।
খিঁচিয়ে উঠে বললো লম্বার্ড, এ সব কি? মেয়েলী দরদ?