লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠলো ভেরার মুখ। আড় চোখে একবার লম্বার্ডকে দেখে নিয়েই মাথা নিচু করলো ভেরা। আসন্ন বিপদে তাদের মনের দূরত্ব কমেছে, এ ওর হৃদয়ের কাছাকাছি এসে পড়েছে কোন সময়ে, তা আর খেয়াল করতে পারে না কেউ।
ব্লোর কিন্তু তাদের কথা সরাসরি মেনে নিতে পারলেন না। মৃদু প্রতিবাদ করলেন, দ্বীপটা ছোট, আর এই ছোট্ট দ্বীপে তন্ন তন্ন করে আমরা খুঁজেছি তাকে। কিন্তু কোথাও তার অস্তিত্ব আমরা দেখতে পাইনি।
শুনুন মিঃ ব্লোর, ফুঁসে উঠলো ভেরা, পিস্তলটার খোঁজেও আমরা চিরুনী চেরা অভিযান চালিয়েছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। অথচ পরে আবিষ্কার হলো, পিস্তলটা এই দ্বীপেই লুকনো ছিলো।
এবার লম্বার্ড মৃদু হেসে বললো, তুমি কিন্তভুল করছ ভেরা, পিস্তলের আকৃতি আর মানুষের আকৃতির মধ্যে ফারাক অনেক। এ দুটো ব্যাপার এক সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার মতো বোকামো করো না।
আপনি যাই বলুন না কেন, মাথা দুলিয়ে বললো ভেরা, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই দ্বীপেই কোথাও লুকিয়ে আছে সে। এ রকম পাগল এর আগে আমি কখনো দেখিনি। কবিতায় যেমন লেখা আছে হুবহু সেই ভাবেই আমাদের দুজন সঙ্গীকে খতম করলো সে। দম আটকে মারলো মার্স্টানকে। চির ঘুমে পাড়িয়ে রাখলো মিসেস রগার্সকে। রগার্সকে গলাটা নামিয়ে দিলো ধড় থেকে আর মিস্ ব্লেন্টকে মারলো মৌমাছির হুল ফুটিয়ে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার বলুন তো। আমাদের প্রাণ নিয়ে এ কি সর্বনাশ খেলায় মেতে উঠেছে ঐ খুনে লোকটা।
ভয় নেই, হাল্কা সুরে বললেন ব্লোর, এখানে কোথাও চিড়িয়াখানা নেই। তাই ভালুক /৫৪ আমদানি করে তাকে দিয়ে কাউকে মারতে খুনীকে যথেষ্ট কসরত করতে হবে। এই বলে হাসলেন তিনি শব্দ করে।
ভেরা তাকালেন ব্লোর-এর দিকে, কে বললে আপনাকে এখানে চিড়িয়াখানা নেই? গতকাল যে ভাবে আমরা রাত কাটিয়েছি তা তো পশুরই নামান্তর। আমরা পশু না হলে অমন সন্দেহ মানুষ মানুষকে কি করে করতে পারে?
তার সেই কঠিন কথাটা শুনে স্তব্দ বিমূঢ় হয়ে গেলেন ব্লোর।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পাহাড়ের চূড়ায় বসে এক নাগাড়ে আয়নায় সূর্যের রশ্মি ফেলতে গিয়ে পুরোপুরি ব্যর্থ হলো লম্বার্ড। চারিদিকে কুয়াশা তখন, সেই কুয়াশা ভেদ করে সে রশ্মি স্টিকলহ্যাভেন পর্যন্ত পৌঁছলো কিনা, তা সেখানকার লোকরাই বলতে পারে। তবে ওপার থেকে একখানা লঞ্চ দূরের কথা একখানা ডিঙি নৌকাও এগিয়ে এলো না তাদের উদ্ধার করার জন্য।
এরই মাঝে পলাতক ডঃ আর্মস্ট্রংকে খুঁজে বার করার জন্য সব রকম চেষ্টাই ব্যর্থ হলো। নিগার দ্বীপের ত্রিসীমানায় তার অস্তিত্ব দেখা গেলো না।
ব্যর্থ কাজের আবর্জনা সরিয়ে অন্য দুজন যখন কপালের ঘাম মুছে ফেলতে ব্যস্ত, ভেরা তখন অস্ফুটে বলে উঠলেন আমি আর প্রাসাদে ফিরে যাচ্ছি না। এখানে এই আকাশের নিচে উন্মুক্ত জায়গায় অনেক নিরাপদ।
কথাটা তুমি মন্দ বলো নি। তাকে সমর্থন করলো লম্বার্ড। এখানে থাকার সুবিধে হলো, চারিদিক খোলা, যেদিক দিয়েই খুনী আসুক না কেন, আমাদের দৃষ্টি এড়াতে পারবে না সে।
তাই বলে সারা রাত এখানে পড়ে থাকা যায় না, মাথা নাড়লেন ব্লোর। দিনের বেলায় সেখানেই থাকি না কেন রাতে একটা আস্তানা চাই বৈকি। তাই প্রাসাদে আমাদের ফিরে যেতেই হবে।
আপনারা যান, আমি যাবো না। ওই মৃত্যু পুরীতে, উঃ কি ভয়ঙ্কর ছিলো কালকের রাতটা, ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে দেয়, অজানা আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠলো ভেরা।
আমার চিন্তা শুধু রাতের জন্য নয়, মিঃ লম্বার্ড, ব্লোর বললেন, এখন আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। পেটে কিছু না দিলেই নয়। আপনার কি অভিমত?
আ-আমি কি আবার বলবো। একটু ইতস্ততঃ করে কোনো রকমে বললো লম্বার্ড, আপনি যান, আমি বরং মিস ক্লেথনের সঙ্গে থেকে যাই।
ঠিক আছে, আপনারা এখানে থাকতে চাইছেন থাকুন। আমি আর বাধা দেবো না। ভেবেছিলাম, এখানে যে কদিন থাকি সবাই এক সঙ্গে থাকবো। তাছাড়া সত্যি কথা বলতে কি আমরা এখন কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। যাই হোক লম্বার্ডের দিকে ফিরে ব্লোর বলেন, প্রাসাদে আমি এখন একাই থাকবো। দেখবেন পিস্তলের মুখটা যেন আমার দিকে ঘুরিয়ে দেবেন না, আপনার কাছে পিস্তলটা এখনো আছে। বিশ্বাসঘাতকতা করবেন নানা।
তারপর এক মুহূর্তও আর দাঁড়ালেন না তিনি সেখানে। তাঁর গমন পথের দিকে তাকিয়ে মুখ খারাপ করলো লম্বার্ড, একেবারে জানোয়ার। ক্ষিদে সহ্য করতে পারে না, পেটের টানে চললো এখন প্রাসাদে।
চিন্তায় পড়লো ভেরা, উনি একা গেলেন, কাজটা বোধ হয় ভালো করলেন না।
ভয় নেই, আর্মস্ট্রং এর হাতে কোনো অস্ত্র নেই। আর শক্তিতে ওঁরা দুজনেই সমান। যাই হোক প্রাসাদে আর্মস্ট্রং এর থাকার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। আমি জানি সেখানে নেই সে।
কিন্তু অন্য আর কি সমাধান হতে পারে? কাকেই বা সন্দেহ করা যেতে পারে?
কেন, ব্লোরকে।
ওঁ। আপনি কি সত্যিই তাই মনে করেন? শোনো ভেরা ক্লোরের কাহিনী তুমি তো শুনেছো। তোমাকে স্বীকার করতেই হবে, সেটা সত্য কাহিনী হিসাবে যদি ধরে নেওয়া হয়, তাহলে আর্মস্ট্রং এর নিরুদ্দেশ হওয়ার ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই। তার কাহিনী আমার কাছে পরিস্কার। কিন্তু সেটা আর্মস্ট্রংকে ঠিক পরিস্কার করতে পারে না। আমার তার মুখ থেকে শুনেছি, পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েছিল সে, সামনের দরজা দিয়ে একজন লোককে বেরিয়ে যেতে দেখেছে। সমস্ত ব্যাপারটাই মিথ্যে হতে পারে, সাজানো গল্প হতে পারে। হয়তো কয়েক ঘণ্টা আগেই আর্মস্ট্রংকে খতম করে এসেছিল সে নিজেই।