অবশেষে একদিন ভাগ্য ফিরল তার। রুগীর সংখ্যা ক্রমশই বেড়ে চললো, জমজমাট চেম্বার। দুহাত ভরে এল অর্থ, এলো সম্পদ, এলো মান যশ সব কিছুই। তার রোগ বিশ্লেষণ একেবারে নিখুঁত। সঙ্গে সঙ্গে দুচারজন বিত্তবান রোগিনীও জুটে গেলো, তারা তাঁর অনুরক্ত হয়ে পড়লো অচিরেই। ব্যস আর পাওয়ার বাকি রইল বা কি? তার প্রশংসা তখন সবার মুখে মুখে। তার অনুরক্ত রুগীদের বক্তব্য ছিলো এই রকম শুধু শুধু অসুখে কষ্ট পাচ্ছেন কেন? আমার কথায় আস্থা রেখে না হয় একবার ডঃ আর্মস্ট্রংকে দেখিয়ে আসুন না কেন-ছোকরা ডাক্তার হলে হবে কি বুদ্ধিতে বয়স্ক ডাক্তাররাও হার মানতে বাধ্য তার কাছে। আর রোগ নির্ণয়? একেবারে নিখুঁত। আরে আমার কথা যদি বিশ্বাস নাই হয় তো আমাদের পামের কথাই ধরুন না। কেন বেচারী কতো ডাক্তারই না বদলালো, কিন্তু রোগের আর সারে না তার। শেষে একদিন আমিই তাকে জোর করে ডঃ আর্মস্ট্রং-এর চেম্বারে নিয়ে গেলাম। ভাল করে দেখে-শুনে প্রেসক্রিপসন লিখে দিলেন তিনি। তার নির্ধারিত ওষুধ কয়েকদিন খেতেই পাম-এর দুরারোগ্য রোগ পালিয়ে যেতে পথ পেল না। কথায় বলে যার ভাগ্য সহায়, তাকে উন্নতির শিখর থেকে নামায় কার সাধ্য। এবং হলোই তাই শেষ পর্যন্ত।
লক্ষ্যে পৌঁছনোর পর চেম্বারে ভর্তি রুগী সামলাতে হিমসিম খেয়ে উঠতে হয় তাকে। এখন দম ফেলবার সময় নেই একটুও। তবে গোড়ায় এমনি কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে ভাল লাগতো তাঁর, কিন্তু এখন ক্লান্তি আসে ভীষণ।
তবে আজ আর ক্লান্তি নয়। আজ সকাল থেকেই বেশ খুশি খুশি ভাব তার। তার কারণ ডিভনের উপকুলে যাচ্ছেন তিনি কটা দিন কাটিয়ে আসবেন, তাতেই তার এত খুশি। এ যাওয়া যদিও ছুটি উপভোগ করার জন্য নয়, কর্তব্যের খাতিরে যাওয়া, তবু রথ দেখা, সেই সঙ্গে কলা বেচার মতোন একটু বেড়িয়ে আসা মন্দ কি। অবশ্য চিঠিতে স্পষ্ট করে কিছু লেখা নেই, কিন্তু চিঠির সঙ্গে পাঠানো মোটা অঙ্কের চেক। কম লোভনীয় নয়। পনেরোটা দিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করলেও ঐ পরিমাণ অর্থ উপার্জন করা যেতো না।
তবু মিঃ ওয়েনের উদার মন বটে। এক সঙ্গে অভোগুলো টাকা অগ্রিম ছাড়াও সেখানে গেলে আরো কত দেবেন কে জানে। অথচ চিঠিতে উনি যা লিখেছেন, তাতে তোমার মনে হয় না, ব্যাপারটা খুব একটা গুরুতর। স্ত্রীর অসুখে স্বামী বেচারা খুব চিন্তায় পড়ে গেছেন। তার স্ত্রী নাকি ডাক্তার দেখলেই ভয় পান, তাঁর নার্ভে নাকি তাই তার স্ত্রীর অজান্তে কায়দা করে রোগ নির্গয় করতে হবে, রিপোর্ট দিতে হবে মিঃ ওয়েনকে।
স্ত্রীর নার্ভ নাকি খুবই দুর্বল। ভরু কুঁচকে উঠলো ডঃ আর্মস্ট্রং-এর এই সব মেয়েদের রকমসকম দেখলে তাজ্জব বনে যেতে হয়। যাকগে বাপু, আমার তাতে কি? আগাম টাকা যখন হাতে এসে গেছে, রোগিনীর নার্ভ যাই হোক না কেন, তাকে দেখতে তো যেতেই হবে, ডঃ আর্মস্ট্রং এ পর্যন্ত যতোগুলো মহিলা রোগিনীর চিকিৎসা করেছেন, তাদের মধ্যে অর্ধেক নার্ভ-এর অসুখে ভুগছে–এ অসুখের উৎস হলো একাকীত্ব এবং নিঃসঙ্গতা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, তাদের এই রোগের ব্যাপারে উপদেশ দিতে গেলেই অমনি গোঁসা হয়ে যাবে। সেটা অন্য ভাবে নেবে। আরে বাপু, আমার উপদেশ যদি তোমাদের মনঃপুত নাই হয় তো কে তোমাদের মাথার দিব্যি দিয়েছে একা একা থাকার জন্য, তা একটা সঙ্গী জুটিয়ে নিলেই তো পারো। শুধু শুধু আমার সময় নষ্ট করা কেন।
এ সব রোগিনীদের জন্যে প্রেসক্রিপসনের বয়ান একই রকমের অমুক গ্রন্থি কিংবা অমুক প্রত্যঙ্গ (কয়েকটা বড় বড় গালভরা নাম ঢুকিয়ে দিলেই চলবে) সামান্য একটু অস্বাভাবিকতা, তাতে তেমন গুরুতর কিছু নয়। কিছুকাল চিকিৎসা করলেই আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারবে রোগিনী। এর চিকিৎসা অতি সাধারণ।
আরে বাপু, সব সময় রোগ ওষুধে সারে না, বিশ্বাস রাখতে পারলে অনেক রোগ বিনা ওষুধেই সেরে যায়। কথায় আছে ওষুধ না খেলে তিনদিনে, আর ওষুধ খেলে সাতদিন। এই যে আমরা চিকিৎসকরা সময় সময় রুগীর মানসিকতা লক্ষ্য করে (হয়তো এমন কোন রুগী আছে যারা মনে করে থাকে, সদ্য সদ্য ওষুধ খেলেই তার রোগ বুঝি সেরে যাবে) প্রয়োজনে শিশিতে স্রেফ রঙীন জল ঢেলে ওষুধ বলে যে চালিয়ে দিই তা কি কেউ ধরতে পারে? পারে না। ঐ যে বললাম, বিশ্বাসে রুগীর অর্ধেক রোগ সেরে যেতে বাধ্য, আর বাকিটা ওষুধের গুণে সারে।
হ্যাঁ, সঠিক রোগ নির্ণয় তো ছিলোই ডঃ আর্মস্ট্রং-এর। তার ওপর সেই যে তার ভাগ্যের চাকাটা ঘুরতে শুরু করলো, তারপর থেকে দুর্বার গতিতে বেড়ে চলেছে তাঁর পসার, সঙ্গে সঙ্গে আয়ের অঙ্কটাও। সে আজ দশ, না দশ নয়, পনেরো বছর অতিবাহিত হলো। উঃ ভাবলে আজও বুকটা কেমন কেঁপে ওঠে বেদনায়, অভাব অনটনে দিন কাটছে তখন। মনে একটুও শান্তি নেই, নেই স্বস্তি। দুবেলা পেট ভরে খাওয়ার মতো রোজগার করে উঠতে পারিনি তখনো, মদ খাওয়াটা একটা ভয়ঙ্কর বিলাসিতা বই আর কিছু নয় বলেই মনে হতো তখন। মনে তখন দারুন চিন্তা প্যাক্-প্যা-অ-ক।
হোঁচট খেলো ভাবনা। তীব্র হর্ণের আওয়াজে পাহাড় মাঠ প্রান্তর কাঁপিয়ে ঝড়ের বেগে পাশ কাটিয়ে ছুটে গেলা একখানি স্পোর্টস গাড়ি। দেখছ ছোকরার কাণ্ড। কম করেও ঘণ্টায় আশী মাইল বেগে গাড়ি চালাতে আছে গ্রাম-গঞ্জের রাস্তায়? বয়স কম, তাই এমন ডাকাবুকো, এতো তেজ! আর বাপু, এখানে কেন? তেজ দেখাতে হয় তো অন্য কোথাও গিয়ে দেখাও না। এ সব বোকামো ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে। বোকার হদ্দ সব।