বেলহ্যাভেনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে। কে-কে হতে পারে সে? আর সে পুরুষ, নাকি মহিলা? সাকুল্যে দুবার বেলহ্যাভেনে গেছেন তিনি। মনে আছে সেই মাঝবয়সী ভদ্রমহিলার কথা, খুব ভাল লেগেছিল তাঁকে, কিন্তু কি যেন নাম ছিল তার? ঠিক সময়ে আজকাল স্মৃতিশক্তিটা বড় বিশ্বাসঘাতকতা করে, কিছুতেই আর মনে পড়ে না নামটা। হ্যাঁ, এবার যেন মনে পড়ছে তার নামটা। মিসেস অলটোন না, বোধহয় মিসেস অরমেন। না ও দুটোর কোনটাই নয়। অ-অ-অহা, এবার ঠিক মনে পড়েছে, মিসেস অলিভার, হা মিসেস অলিভারই ছিলো ভদ্রমহিলার নাম।
নিগার একটি দ্বীপ–একসময় এই দ্বীপটিকে কেন্দ্র করে প্রচুর লেখালেখি হতে সংবাদপত্রে, সেই সুবাদে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল এই নিগার আইল্যাণ্ড। সেই সব খবরের তালিকায় এখন নাম শোনা যেত এক চিত্রতারকার, নাকি সেই আমেরিকাবাসী কোটিপতি ভদ্রলোকের কে জানে, ঠিক মনেও নেই আর মনেই বা থাকবে কি করে? উঃ সে কি আজকের কথা? অনেক অনেক আগের কথা।
যাকগে, সঠিক সময়ের হিসাব করতে বসে মিথ্যে সময়ের অপচয় বই তো আর কিছু নয়। ও নিয়ে আমার মাথা ঘামানোরও কোনো প্রয়োজন নেই। আমি যাচ্ছি সেখানে ছুটি উপভোগ করতে। কয়েকটা দিন থাকবো, আমোদ করবো, ব্যস তাতেই আমার যথেষ্ট। আর বড়তি লাভের মধ্যে সেখানে থাকা খাওয়ার কোন খরচ হবে না আমার এটাই সব থেকে বড় লাভ আমার।
আজকাল আমার আয় যৎসামান্য, সেই দিন আর নেই, শেয়ারের ডিভিডেন্টের টাকা কমেই শুধু যায়নি, বড় অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। এদিক-ওদিক করে, অপ্রয়োজনীয় খরচগুলো ছাঁটাই করে কোন রকমে চলে যায় সংসার। সে কথা চিন্তা করলে নিখরচায় এমন একটা লোভনীয় বন্দোবস্ত, সেটা কি কম সুখের?
এ পর্যন্ত সবই ভাল চলছিল, সুন্দরএবং সুষ্ঠভাবে কেবল সেই একটি নাম মিস্ না মিসেস অলটোন, নাকি অরমেন? না অরমেন না, তবে কি অলিভার। সঠিক নামটা যদি জানা যেত?
ট্রেন তখন এক্সেটার জংশনে ঢুকছে, জানলা পথে মুখ বাড়িয়ে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলেন জেনারেল ম্যাকআর্থার। জিনিসপত্র গোছগাছ করতে শুরু করে দিলেন তিনি–এক্সেটার স্টেশনে নেমে গাড়ি বদল করতে হবে। এটুকু পথ এসেই বিরক্তবোধ করলেন তিনি। ব্রাঞ্চ লাইনের ট্রেনগুলো কতই না মন্থর, নড়তে চড়তে আঠারো মাস। এতো সময় লাগার কথা নয়। সোজা পথে নিগার আইল্যাণ্ড বলতে গেলে এক রকম ঘরের কাছেই।
গোছগাছ করার ফাঁকে জেনারেল ম্যাকআর্থার ভাবলেন, এই ওয়েন লোকটি কে? স্পুফ লেগার্ড না জানি ডায়ার্স, কার, কার বন্ধু সে?
আপনার অতীত দিনের কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবরা আসছেন এখানে। তা আপনিও চলে আসুন না? খুব ভাল হত, বেশ জমিয়ে আড্ডা মারা যাবেখন
একটা নিঃস্বার্থ আমন্ত্রণ, লোভনীয় আকর্ষণও বটে। পুরনো সব বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হতে কারই বা মন চায় না। এই বয়সে নতুন করে কার সঙ্গেই বা মেলা-মেশা করবেন?
তা ছাড়া এ-প্রসঙ্গে কথা উঠলে আজকাল বন্ধু বান্ধবরা কেমন যেন এড়িয়ে চলে। মনে পড়ে যায় সেই বছরটার কথা। কিন্তু সে তো আজ বছর তিরিশ আগেকার কথা-তামাদি হয়ে গেছে কবেই। সেদিন আমির্টেজ যদি না মুখ খুলতে না আজকাল ছেলে-ছোকরাদের বিশ্বাস করা যায় না। কে কি বললো, কিংবা কে কতখানি জানলো বোঝা মুশকিল, মনে হয় ঈশ্বরই হয়তো জানেন। যাই হোক যে যার খুশী মত বলুক, আমার তাতে কি এসে যায়? কতো লোক আমার অজান্তে কত কিছুই না বলে থাকে। সব কথা সরাসরি আমার কানে না এলেও তাতে কিছু আসে যায় না, গুজবে কান দেবার মতো অতো সময়ই বা কোথায়? তাছাড়া চলার পথে আর বলা মুখতো আর বন্ধ করা যায় না আজকাল। নিগার আইল্যাণ্ডের মানুষগুলোই এই রকম। আর গুজবে কান দেওয়ার ব্যাপারটা বেমালুম চেপে যাওয়াই তাদের কাজ। কিন্তু তা নিয়ে মন খারাপ করাটা উচিৎ নয়, গুজবের তো আর মা বাপ নেই? যখন খুশি যেখানে খুশি বলেন ও তাতে আমার কি এসে যায়? এক্ষেত্রে গুজব কানে না তোলাই ভালো।
যে যাই বলুক। সেই আমেরিকাবাসী কোটিপতি এলমার রোবসনই না কি এই দ্বীপটির আসল মালিক। বহু টাকা ব্যয় করে তৈরি করেছিলেন সুন্দর একটা প্রাসাদ। নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য মনের মতো করে গড়িয়েছিলেন সেই প্রাসাদ। কিন্তু
এই সময় বাধা পড়লো তার চিন্তায়। বাইরে তাকিয়ে দেখতে পেলেন তিনি, ট্রেনটা এসে থেমেছে এক্সেটার স্টেশনে, কোন তাড়াহুড়ো নেই, ধীরে ধীরে ট্রেন থেকে নামলেন তিনি। কব্জি ঘড়ির ওপর চোখ রেখে হিসেব করে দেখলেন, বদলি ট্রেনের জন্য পাক্কা এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে তাকে। ওঃ যন্ত্রণার একশেষ একেবারে।
ডঃ আর্মস্ট্রং তার ছোট মরিস গাড়িটি সালিসবারির রাজপথ ধরে দ্রুতবেগে চালাচ্ছিলেন। একটানা অনেকটা পথ গাড়ি চালিয়ে এসে এখন খুবই ক্লান্ত তিনি, মনে মনে ভাবছিলেন, পথে কোথাও গাড়ি থামিয়ে গলাটা একটু ভিজিয়ে নিলে মন্দ হতো না। আজ তিনি সফল তার পেশায়। তবে এ সাফল্য কুসুমাস্তীর্ণ নয়। মনে পড়ে, এমনও দিন গেছে, হারলি স্ট্রীটের আধুনিক কায়দায় সাজানো গোছানো চেম্বারে বসে রুগীর জন্যে অপেক্ষা করতে করতে সারাটা দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে, তবু রুগী আসেনি একটিও। তবে চিকিৎসব হিসাবে বড় একটা খারাপ ছিলেন না তিনি। চিকিৎসা পদ্ধতি বেশ ভালই জানা ছিলো তার। বয়সও কম ছিলো তখন, দেখতে শুনতে বেশ ভাল ছিলেন তা সত্ত্বেও কেন জানি না শুরুতে তেমন পসার কেন যে জমেনি তার কারণ বোধহয় নিজেও জানতেন না তিনি।