তা না হয় হলো কিন্তু আপনি তো জানেন, তার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়ালের দিকে চোখ রেখে বললাম কোন বে-আইনী কাজে আমার একেবারে আগ্রহ নেই। তাই বলছিলাম কি
আরে আগে থেকেই ওসব চিন্তা করছেন কেন?
আমাকে থামিয়ে দিয়ে আইজ্যাক বলছিল, তেমন বে-আইনি কাজ দেখলে আপনি করবেনই বা কেন। তখন পত্রপাঠ চলে আসবেন বুঝলেন?
ব্যাপার দেখো। বাস্তুঘুঘুটা এমন ভাবে কথা বললো, যেন কিছুই জানে না সে। অথচ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সব জানে ও ভাঙবে তো মচকাবে না। হতচ্ছাড়াটা সব খবরই রাখে, কিন্তু আমার কাছে চেপে যেতে চাইল। ওকে আমি হাড়ে-হাড়ে চিনি একবার তো ও আমাকে–না, থাক। যা হওয়ার হয়ে গে, পুরনো কাসুন্দি এখন না ঘাঁটাই ভাল, এখন আমার একমাত্র চিন্তার বিষয় হলো নিগার আইল্যাণ্ড–এখন আমার সব মন-প্রাণ জুড়ে রয়েছে প্রকৃতির সৌন্দর্যে ঘেরা সেই সবুজ দ্বীপটি। আঃ কি মজাই না হবে সেখানে গেলে। কটা দিন দারুণ স্ফূর্তিতে কাটানো যাবে।
এতো বড়ো ট্রেনটায় মাত্র একটাই কামরা অধূমপায়ীদের জন্য। তাই দেখে শুনে এই কামরাটাতে উঠেছিলেন মিস এমিলি ব্রেন্ট। ধূমপায়ীদের কামরার কথা অনুমান করে নিয়ে ভাবতে গিয়ে তার গা ঘিন ঘিন করে ওঠে। চারিদিকে চুরুট আর তার সিগারেটের ধোঁয়া কুণ্ডলী, উঃ অসহ্য! আচ্ছা রাশি রাশি ধোঁয়া উড়িয়ে কি সুখ যে পায় লোকগুলো, ভেবে পান না তিনি।
সোজা হয়ে বসেছিলেন তিনি তার আসনে। হেলান দিয়ে বসাটা তার ধাতে সয় না, ওঁর মতে যাদের মেরুদণ্ড বলতে কিছু নেই তারাই হেলান দিয়ে বসে। বয়স তার পঁয়ষট্টি। তবু এতো বয়সেও একটুও বুড়িয়ে যাননি তিনি এখনো, রাস্তায় হাঁটেন মেরুদণ্ড টানটান থাকেও তার, বসেনও সোজা হয়ে। কর্ণেলের মেয়ে তিনি, এ সব আদব কায়দা সেই কোন্ ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছেন তিনি, এবং সেই ভাবেই চলে আসছেন সোজা।
আগের দিনের শিক্ষাদীক্ষা তাদের আদব-কায়দার ধরণই ছিল অন্য রকম। স্বাস্থ্য ও চরিত্র গঠনের মধ্যে একটা নিষ্ঠার ভাব ছিলো। কিন্তু এখন। দিনকে দিন সব যেন কেমন উধাও হয়ে গেলো। এখানকার ছেলে-মেয়েরা যেন এক একটা ননীর পুতুল, গাল টিপলে দুধ বেরোয়। আজকালকার নব্য মানুষজনদের জীবন ও কাজকর্ম করার পদ্ধতির বিষয়ে এই রকম বিতৃষ্ণা নিয়ে নীরবে বসেছিলেন মিস্ ব্রেন্ট তার আসনে। প্রচণ্ড ভীড় ছিল কামরায়, সেই সঙ্গে প্রচণ্ড গরম, তবু বিন্দুমাত্র বিচলিত নন তিনি। অথচ অন্য সব যাত্রীদের কতই না অভিযোগ, কতই অস্বস্তি বোধ। তাদের না আছে একটু ধৈর্য, না আছে একটু ভদ্রতাবোধ। এর জন্যে যে তাদের সহযাত্রীদের কি অসুবিধে হতে পারে, সেটা চিন্তা করার প্রয়োজন মনে করে না তারা। কি বিচিত্র মানুষ।
আর মেয়েগুলোও কেমন সমানে তাল দিয়ে চলছে পুরুষদের সঙ্গে আজকাল। ওদের ধিঙ্গি পনা দৃষ্টিকটু। গরমের দোহাই দিয়ে দেখা যাবে, সমুদ্রের তীরে গিয়ে কোন রকমে দেহের সব পোষাক আসাক খুলে ফেলে শরীরটা যতখানি সম্ভব পাঁচজনকে যেন না দেখালেই নয়, রোদ পোহানোর ছুতো করে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়বে বালির ওপর। যতো সব ভণ্ডামি ন্যাকামি।
একরাশ বিরক্তি আর ঘৃণায় ভুরু কোঁচকালেন মিস ব্রেন্ট। সহ্য করতে পারেন না তিনি এ সব ন্যাকামি। তবু নিজের মনেই তিনি বললেন, যার যা খুশি করুকগে, আমি বাবা এসবের মধ্যে নেই। আমি আমার আদর্শ নিয়ে থাকতে চাই। কোন কিছুর বিনিময়েই আমি আমার আদর্শকে বিসর্জন দিতে পারবো না। এসব বেলেল্লাপনাদের কথা ছেড়ে দিয়ে আমি এখন নিজের কথা, স্রেফ নিজের কথা নিয়েই ভাবতে চাই
হ্যাঁ, এখানে যার আহ্বানে তার নিগার আইল্যাণ্ডে যাওয়া, তার সেই চিঠির প্রতিটি অক্ষর এতদিনে একেবারে মুখস্থ হয়ে গেছে।
প্রিয় মিস্ ব্রেন্ট,
আমার বিশ্বাস, আপনি আমাকে ভুলে যাননি একেবারে। মনে আছে আপনার সেই বেলহ্যাভেন গেস্টহাউসের কথা, সেখানে কয়েক বছর আগে পুরো আগস্ট মাসটা কাটিয়েছিলাম দুজনে? মনে করতে পারছেন নাতো? ঠিক আছে, আমি আপনাকে সূত্র ধরিয়ে দিচ্ছি–আমাদের দুজনের স্বভাবে এত মিল ছিলো, যার জন্যে আমর পরস্পরের কাছে অচিরেই অত্যন্ত ঘনিষ্ট হয়ে পড়ি, এবার মনে পড়ছে?
তা এবার আর অন্য কোথাও থাকা চলবে না। আপনাকে একটা সুখবর দিই, ডিভনের উপকূল ছাড়িয়ে খানিকটা দূরে নিজেই একটা গেস্টহাউস খুলেছি। এখানে বিলাসিতার বালাই নেই, সাদামাটা খাবারের সুবন্দোবস্ত আছে, পরিবেশে যতোটা সম্ভব পুরনো দিনের ছাপ রাখার ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়েছে। এখানে বেলেল্লাপনা করার বিন্দুমাত্র সুযোগ দেওয়া হয় না।
এবার গ্রীষ্মে ছুটি উপভোগ করার জন্যে চলে আসুন আমার গেস্টহাউসে, এই আমার ইচ্ছা, আপনাকে অতিথি হিসাবেই রাখতে চাই, তাই খরচ-পত্তর নিয়ে খামোকা চিন্তার কিছু নেই আসুন যতদিন খুশি থাকুন এখানে, ভাল না লাগলে চলে যাবেন, জোর করবে না, তাহলেই হলো তো? কোন দ্বিধা না করে চলে আসুন, পারেন তো চলে আসুন না আগামী আট তারিখে।
—প্রীতি ও শুভেচ্ছান্তে
ইউ. এল. ও
চিঠির বক্তব্য তো খুবই ভাল, আন্তরিকতায় ভরা। কিন্তু মুশকিল হলো, পত্রপ্রেরকের নামটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। সেইটা জড়ানো, খুবই অস্পষ্ট। এরই মাঝে কোন রকমে ঐ তিনটি আদ্যাক্ষর পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। আজকাল সব সই-এর যা বহর, হস্তরেখা বিশারদদের কাছেও সঠিক নাম উদ্ধার করা একেবারেই অসম্ভব।