কিন্তু সিরিল, সিরিলের ব্যাপারটা–
যা হবার হোক, ও ব্যাপারে আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না। যা হয়ে গেছে তা তো আমি আর খণ্ডাতে পারিনা। তাহলে অকারণ চিন্তা করে শুধু মনটাই বা খারাপ করি কেন।
ভাববো না বললেও কি চুপ করে থাকতে পারি। বড্ড জানতে ইচ্ছে হয়, করোনার কি আদৌ আমাকে সন্দেহ করেছেন? আমার ধারণা যদি সত্যি হয়, তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে করেননি। একটা সুখের ব্যাপার হলো, বরাবর তার ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছি আমি। আর কেনই বা ধরবেন তিনি আমাকে?
আরো আছে আমার বুদ্ধি আর সাহসের প্রশংসা নিজের মুখেই করেছেন তিনি অনেকবার। তাছাড়া আর একজনের তারিফ করতে হয় বৈকি, তিনি হলেন মিসেস হ্যামিল্টন। আমার ব্যাপারে যথেষ্ট সহৃদয়তার পরিচয় দিয়েছেন তিনি, ওঁর ওপর আমার এখন অগাধ বিশ্বাস। অতএব আমার কিসের ভয়।
যত ভাবি ভুলে যাবো, কিন্তু পারছি কই ভুলতে। উঃ কি ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য। আজো যেন স্পষ্ট ভাসছে চোখের সামনে। যেন মনে হয়, গতকালের ঘটনা, অত্যন্ত স্পষ্ট সেই ছবি, মাথা ঘুরে যাওয়ার ছবি মনে আছে, সিরিলের মাথাটা একবার ডুবছে আবার ভেসে উঠছে। আশানিরাশার দোলায় দুলছিল সে তখন। আর এদিকে সাঁতার কেটে এগুচ্ছি অলস ভঙ্গিতে। আমি তখন বেশ বুঝে গিয়েছিলাম, আমি যতোই চেষ্টা করি না কেন ঠিক সময়ে পৌঁছে তাকে উদ্ধার করা আর সম্ভব হবে না।
সুদুর বিস্তৃত দিগন্ত প্রসারী সেই নীল ফেনিল জলরাশি, প্রায় পাহাড় সমান উঁচু উঁচু ঢেউ এসে বারবার আছড়ে পড়ছে সমুদ্র পারে, যেদিকে দুচোখ যায় শুধু বালিয়াড়ি–তার ওপর শুয়েছিলাম আমরা দুজন, মানে আমি আর হুগো, ও নাকি ভালবাসতো আমাকে।
হুগো! ও এখন আমার কাছে স্মৃতি, শুধুই স্মৃতি, ফেলে আসা দিনের যেন একটি অধ্যায়ের এক অস্পষ্ট ছায়া মাত্র। তাই হুগোর কথা আর ভাবতে চাইনা। স্মৃতি শুধুই বেদনা…..
অতীত পেরিয়ে এবার বাস্তবে ফিরে এলো ভেরা। তাকালো চোখ মেলে। এবং চোখ মেলে ভাল করে তাকাতেই বিপরীত দিকের আসনে বসা সেই যাত্রীটির সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেলো ওর। দীর্ঘদেহী পুরুষ দোহারা চেহারা, বাদামী রঙ গায়ের, চোখ দুটি বেশ ছোট ছোট, তার গোটা চেহারার মধ্যে কেমন যেন একটা কাঠখোট্টা ভাব। মুখ দেখলেই বোঝা যায়, বিশ্বের অনেক দেশ তার দেখা হয়ে গেছে, অনেক দেখেছে, জেনেছে। অবশ্যই না হয়েই যায় না।
ওদিকে বিপরীত দিকের আসনে বসে থাকা যাত্রীটিও চুপ করে বসে থাকেনি, মেয়েটিকে কাটা মাছ বাছার মতোন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল ফিলিপ লম্বার্ড।
হ্যাঁ, মেয়েটি সত্যিই সুন্দরী বটে, মনে মনে ওর রূপের তারিফ করল সে, তবে একেবারে অপ্সরী না হলেও দেখতে বেশ, চোখে লাগার মতোন। একটা আলগা শ্ৰী আছে ওর চেহারায়।
গোল গোল সাদামাটা গড়ন। মাস্টারনী মাস্টারনী ভাব। মুখ দেখে মনে হয়, এই মেয়েটির ওপর নিঃসঙ্কোচে নির্ভর করা যায়। ফায়দা কিছু না লুটুক, তবে এটা ঠিক, ক্ষতি-টতি করার সাহস পাবে না। তা একবার একটু পরখ করে দেখলে কেমন হয়।
না, থাক, এখন ওসব চিন্তা মুলতুবি রাখাই ঠিক। যে কাজে আসা, সেটা ঠিক মতো সমাধা না করা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না। আগে সেই কাজটা সারি। তারপর অন্য কাজটা একটু বিচিত্র ধরণের। বুড়ো ইহুদি আইজ্যাক মরিস শোনা যাচ্ছে রাতারাতি দানছত্র খুলে বসেছে। কিন্তু কেন? এর রহস্যই বা কি?
আইজ্যাকের কথাটা মনে পড়ে গেলো, বলেছিল সে, দেখুন কাপ্টেন লম্বার্ড, তাড়াহুড়োর কিছু নেই, বেশ ভাল করে একটু চিন্তা ভাবনা করে বলুন, কাজটা করতে আপনি উৎসাহী কি না।
বলছেন একশো গিনি দেবেন? আমার কথার মধ্যে একটা অনাগ্রহের সুর ছিলো, ইচ্ছে করেই আমি তাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম, একশো গিনি আমার কাছে এমন কিছু লোভনীয় নয়। কিন্তু আসলে ঠিক তা নয়, আমার পকেট তখনো একেবারে শূন্য। দুবেলা অন্ন সংস্থান করতে আমার তখন প্রায় প্রাণান্তকর অবস্থা। এ-হেন অবস্থায় স্বভাবতই একশো গিনি আমার কাছে তখন একটা বিরাট কিছু অবশ্যই, হ্যাঁ, সেটা আমার কাছে একান্ত কাম্য বটে।
ভেবেছিলাম বুড়ো আইজ্যাককে বুঝি বোকা বানিয়ে দিলাম। কিন্তু আমার ধারণা একেবারেই ভুল, আসলে ও একটা আস্ত বাস্তুঘুঘু। বরং আমাকেই ফঁদ দেখিয়ে ছাড়তে পারে। ওকে ঠকাবো আমি? না কস্মিন কালেও সম্ভব নয়।
ভাবলেশহীন চোখে তাকালো আমার দিকে সে, তার কালো ছোপ ধরা দাঁতের ফাঁকে সামান্য একটু হাসি ফুটে উঠতে দেখেছিলাম। যেন একটু দৃঢ়স্বরেই বলল সে, একশোর বেশি হবে না, ওর ওপর আর উঠতে চায় না ওরা।
কিন্তু আমাকে কি করতে হবে, মানে আমার কাজটা কি হবে জানতে পারি?
জানি না, তবে একটু বলতে পারি, যে কাজেই হোক না কেন, মাথা ঠাণ্ডা রেখে করবেন, খুব সাবধানে পা ফেলবেন, করার আগে ভাল করে ভাববেন,ব্যস। এই পর্যন্ত। আর আমার কাজ হলো আপনার হাতে একশো গিনি তুলে দেওয়া। এই নিন একশো গিনি। এখন গন্তব্যস্থল হলো নিশার আইল্যাণ্ড। ওকব্রীজ স্টেশনে নেমে তারপর যেতে হবে স্টিকলহ্যাভেনে, সেখানে থেকে লঞ্চে করে নিগার আইল্যাণ্ড। আমার মক্কেল অপেক্ষা করবেন আপনার জন্যে সেই দ্বীপে।
তা কাদের জন্য কতদিন সেখানে থাকতে হবে আমাকে?
খুব বেশিদিন নয়, বড়জোর সপ্তাহ খানেক।