তা আপনার সেই নিয়োগ কত্তাটি কে জানতে পারি? একটু রুক্ষস্বরেই জিজ্ঞেস করলেন ওয়ারগ্রেভ।
মিঃ ওয়েন। চিঠির সঙ্গে তিনি আমাকে কিছু আগাম টাকাও পাঠিয়ে দেন। আর চিঠিতে নির্দেশ ছিল, এখানে আমাকে আসতে হবে ছদ্মনামে, পরিচয় গোপন রেখে আপনাদের মানে অতিথিদের দলে মিশে গিয়ে আপনাদের ওপর নজর রাখতে হবে।
নজর রাখতে হবে, তার মানে?
বাঃ নজর রাখতে হবে না? মিসেস ওয়েনের কত না সোনাগয়না এখানে মজুত আছে, চুরি হওয়ার ভয় নেই? ব্যঙ্গ করে বললেন ব্লোর তবে আমার ব্যক্তিগত মতামত যদি জানতে চান তাহলে বলবো আদৌ ওয়েন নামে রক্তমাংসের কোন মানুষের অস্তিত্ব কখনো ছিলো না কোথাও আজও নেই।
আপনার ধারণা অভ্রান্তঃ মিঃ ব্লোর। চিন্তিতভাবে ঘাড় নাড়লেন ওয়ারগ্রেভ আমরা দশ দশজন অতিথি এখানে এসে পৌঁছলাম অথচ কি আশ্চর্য তিনি এখনো এলেন না এখানে। তার থেকেও বড় আশ্চর্য হল, আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে যিনি চেনেন ওয়েনদের। আমাদের সকলের কাছেই তিনি এখনো অপরিচিত অজ্ঞাত পুরুষ। আড়াল থেকে একে পর এক নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন, আর আমরা মুখের মতো নীরবে তার সব আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি, তার সেই সব উদ্ভট কল্পনার শিকার হয়েছি কেউ, ভবিষ্যতেও হবো কেউ না কেউ। অর্থাৎ তিনি হলেন কি না কে অতি নিপুন শিকারী আর আমরা হলাম গিয়ে মূর্খ শিকার তার।
এসব হলো পাগলের খেয়াল বুঝলে, তার সব কল্পনার মধ্যেই রয়েছে পাগলামির ছাপ, প্রতিবাদ কর উঠলেন ভেরা।
অলক্ষে অতি সন্তর্পণে ভেরার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে বকে গেলেন বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ। হুঁ তা যা বলেছেন, হ্যাঁ সত্যিই তো পাগলামি ছাড়া আর কিই বা হতে পারে? এখানে আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত জেনেও গলা ফাটিয়ে কেন জানি না আমার বলতে ইচ্ছা হচ্ছে, আমরা পড়েছি এমন এক লোকের পাল্লায় যে কি না অমানুষ নরঘাতী, নিষ্ঠুর এক বদ্ধ পাগল।
.
০৪.
এক সময়ে ঘরে নামলো এক অদ্ভুত নীরবতা। সময় বসে থাকে না কারোর জন্য। ঘড়ির কাঁটাগুলো তাদের স্বাভাবিক গতিতে টিকটিক ধবনি তুলে এগিয়ে চলে,কোথায় থামতে হয় তাও জানে না। আর ওয়ারগ্রেভও থেমে থাকলেন না। তার দৃষ্টি পরিক্রমা করে ভীত-সন্ত্রস্ত কয়েক জোড়া চোখের ওপর, পরিক্রমা শেষে শান্ত অবিচলিত স্বরে বললেন তিনি তদন্তের প্রথম পর্যায়ের কাজ আপাতঃ শেষ, এর পর শুরু হবে দ্বিতীয় পর্যায়ের তদন্ত। ও হ্যাঁ, ভুলেই একটা চিঠি পাই পকেট থেকে সেই চঠিটা বার করে রাখলেন তিনি টেবিলের ওপর, উনি আমার পুরনো বান্ধবী। অবশ্যই অনেক বছর হলো তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। চিঠিটা পড়ে প্রথমে একবারও মনে হয়নি, তিনি ছাড়া অন্য কেউ লিখতে পারেন। সেই পরিচিত ভাষা কাটা কাটা কথা পরিস্কার করে কিছু না বলা, লেখার ভঙ্গিমা সব হুবহু তার মতো। কিন্তু পরে আমার ধারণা পাল্টাতে হলো। আপনাদের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করার পরেই আমার এই পরিবর্তিত সিদ্ধান্ত আমার যা মনে হয়েছে। তা এই যে চিঠিটা যেই পাঠিয়ে থাকুন না কেন, আমাদের সম্বন্ধে সমস্ত ব্যাপারই আগাগোড়া তার জানা। আমার ও লেডী কনস্টান্সের সম্পর্কে অজানা কিছু লেখা সম্ভব হতো না। ডঃ আর্মস্ট্রং-এর বেলাতেও একই কথা প্রযোজ্য। আবার দেখুন সবজান্তার মতো মিঃ মার্স্টানের বন্ধু ডাকনামটাও তার জানা রয়েছে কেমন। এরপর আসা যাক মিস্ ব্লেন্টের কথায় দুবছর আগে গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে তিনি যে বাইরে বেড়াতে গিয়েছিলেন, এ খবরটিও সংগ্রহ করে রেখেছেন তিনি। আর জেনারেল ম্যাকআর্থারের সম্পর্কে কম কিছু জানেন না তিনি। অতএব এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে আমাদের অনেক খবরই তিনি জানেন আর সেই সব খবরের ভিত্তিতেই তাই তো তিনি আমাদের বিরুদ্ধে এমন নির্দিষ্ট অভিযোগ আনতে পারলেন তা তো সবাই আপনারা নিজের কানে শুনলেন।
সঙ্গে সঙ্গে একটা চাপা গুঞ্জন উঠলো। সকলের মুখ বেশ থমথমে। এঁদের মধ্যে ম্যাকআর্থার থাকতে না পেরে ভয়ঙ্কর ক্রোধে ফেটে পড়লেন সব মিথ্যে মিথ্যে অভিযোগ। আমি বিশ্বাস করি না। এই মিথ্যে কলঙ্ক আমি কিছুতেই মেনে নেবো না।
ঠিক কথা, মিথ্যে কলঙ্কই তো। তাঁর ক্রোধ যোগালেন ভেরা, আমিও মানছি না এই মিথ্যে অভিযোগ।
হ্যাঁ মিথ্যেই তো বটে, রগার্সও তার ক্ষোভ প্রকাশ করলো, আমি জোর দিয়ে বলতে পারি আমরা কেউ কোন অন্যায় করিনি করতে পারি না।
এঁকে পাগলা ষাঁড়ের কীর্তি ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে? শ্লেষের সুরে বললো মার্স্টান এই নির্জন দ্বীপে আমাদের ডেকে নিয়ে এসে মজা লুটতে চাইছে নচ্ছারটা। ওর বাঁদরামো এখুনি ঘোঁচাতে হবে।
হাতের ইশারায় সকলকে শান্ত হতে বললেন ওয়ারগ্রেভ। তাতে কাজ হলো শান্ত হলেন সকলে। তারপর তিনি আবার বললেন, তা আমার কথাই ধরুন না কেন? এডওয়ার্ড সিটনের হত্যার ব্যাপারে আমি দায়ী না, অপরাধীও নই। কিন্তু সিটনের কেসটা আমার স্পষ্ট মনে আছে আজও। উনিশশো তিরিশ খৃষ্টাব্দের জুন মাসের কোনো একটা দিন হবে। আমার, এজলাসেই উঠেছিল তার মামলা। একজন বয়স্ক মহিলাকে হত্যা করার অভিযোগে তার বিচার চলছিল। পুলিশ রিপোর্ট, সাক্ষ্য প্রমাণ সবই তার বিরুদ্ধে। কিন্তু আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সরকার পক্ষের উকিলের জেরার উত্তরে সে তার সব অভিযোগ খণ্ডণ করে সে এমন সব তথ্য আদালতের সামনে হাজির করলো যে, তার কথা শুনে জুরীরা শুধু অবাকই হলো না, দারুণ মুগ্ধ হলো। তখন আমি ভেবে দেখলাম, এভাবে চলতে দিলে এ-মামলা তার পক্ষে যেতে বাধ্য। অথচ তার প্রতিটি যুক্তি খণ্ডণ করে দিয়ে সকলেই একমত হয়ে তাদের অভিমত জানালেন, এডওয়ার্ড সিটন দোষী যে নিজে খুন করেছে মহিলাটিকে। অতএব তার সেই অপরাধের শাস্তি-মৃত্যুদণ্ড। আপীল করলো সে তার সেই কঠিন শাস্তি মকুব করার জন্য। আমার অন্যায় রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলো সে। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে তার কোন অভিযোগই গ্রাহ্য হলো না। উচ্চ আদালতে ফাসী হয়ে গেলো সিটনের।