লেডি কনস্টান্স কালসিংটনের সঙ্গে শেষ কবে যেন দেখা হয়েছিল, স্মৃতির পাতা উল্টে খেয়াল করার চেষ্টা করলেন ওয়ারগ্রেভ…….সাত বছর? না সাত নয়, আট-হা মনে পড়েছে। আট বছর আগে সেই শেষ দেখা তার সঙ্গে। একটার পর একটা দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে সে তখন। তখন সে চলেছে ইতালির পথে, সেখানকার রোদে পিঠ দিয়ে সে তার শরীরটা চনমনে করে তুলতে চলেছে। গায়ের রঙ তামাটে করে তোলা, এবং সেই সঙ্গে আকণ্ঠ কন্টাডিনি (মদ) পান করাটাও উদ্দেশ্য ছিল তার। তারপত্র ওয়ারগ্রেভ খবর পেয়েছিলেন কালসিংটন সেখান থেকে পাড়ি দেয় সিরিয়ায়, সেখানকার মরুভূমির রোদ নাকি আরো উজ্জ্বল আরো মিষ্টি। এ ছাড়া আরো একটা আকর্ষণ ছিল বেদুইন। তাদের সঙ্গে মেলামেশা করার ফাঁকে তার ইচ্ছা ছিল, প্রকৃতির সঙ্গে সার্বিক একাত্মতা অনুভব করা–সেইরকম একটা মানসিকতা নিয়েই গিয়েছিল সেখানে সে।
লেডী কনস্টান্স কালসিংটন। বড্ড বেশী খামখেয়ালী। টাকা-পয়সার কথা চিন্তা করেনি সে। তা না হলে এতো দাম দিয়ে এমন একটা দ্বীপ কিনে ফেলল সে? মনের জোর থাকা দরকার, মেজাজ থাকা দরকার। ওয়ারগ্রেভ তখনো ভেবে চলেছেন। নিজের মনেই বলে উঠলেন তিনি, মহিলাটি সত্যিই যেন এক রহস্যময়ী। একটা দ্বীপের মধ্যে অমন একটা বিলাসবহুল প্রাসাদ আর কেই বা কিনতে যাবে? তাকনস্টান্সের পক্ষেই সম্ভব।
নিজের যুক্তির সমর্থনে ট্রেনের পুলিশের সঙ্গে তর্ক করতে করতেই ওয়ারগ্রেভের চোখের চাহনি কেমন যেন একটু ঘোলাটে হয়ে উঠতে থাকে। এদিকে খোলা জানালা পথ দিয়ে দমকে দমকে আসা সেই মিঠে বাতাস, ভালভাবে উপভোগ করার আগেই কোথা থেকে যে রাজ্যের ঘুম এসে জড়ো হল তার দুচোখে, সে খেয়াল তার ছিল না। তার চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো, ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।
ওদিকে তৃতীয় শ্রেণীর ছোট একটি কামরায়, যাত্রী মোট ছজন। মিস্ ভেরা ক্লেথর্ন তাদের মধ্যে একজন। জানালা পথে এতক্ষণ নৈসর্গ শোভা দেখছিল ভেরা। শেষে বড় একঘেয়ে লাগল তার কাছে। সেই একই দৃশ্য। ভাল না লাগা চোখ দুটো বুজিয়ে পিছনের আসনে হেলান দিয়ে বসল।
আজ গরমও পড়েছে প্রচণ্ড, অসহনীয়। রোদের তাপে নীরস পাথুরে মাটি গনগনে অঙ্গারের মতো দেখাচ্ছে। তবে নিগার দ্বীপে এতটা গরম হবে না বলেই মনে হয়। চারদিকে সমুদ্র, মাঝখানে নিগার দ্বীপ। তাছাড়া শোনা যায়, সেখানকার আবহাওয়া নাকি এমনিতেই ঠাণ্ডা, এবং বেশ মোলায়েম। সেই সুন্দর মনোরম আবহাওয়ায় সমুদ্রের শীতল জলে গা ভাসিয়ে দেওয়ার জন্যে প্রায় সব ট্রেন যাত্রীই অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করে রয়েছে। কখন, কখন তাদের ট্রেনটা ওকব্রীজে গিয়ে পৌঁছবে।
বেশ কিছুদিন ধরে কাগজগুলো একটানা কতো গুজবই না রটালো, সত্যি-মিথ্যে মেশানো একটার পর একটা আধা সত্য কিংবা স্রেফ বানানো কাহিনী কাগজে ছাপিয়ে সব না হলেও অন্তত কিছু করতে পেরেছে বৈকি। ভেরা ক্লেথনও তাদের ব্যতিক্রম নয়। তবে বুদ্ধিমতী মেয়ে সে। সব কিছুর চুলচেরা বিচার হয় তার মনের নীরিখে, তার অনুমানের দাঁড়িপাল্লায়, ফুট করে কোন ব্যাপারে বিরূপ সমালোচনা করা, কিংবা কারোর সম্পর্কে ভাসা ভাসা প্রশংসা শুনে সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছ্বাস প্রকাশও করেনা সে কখনো। ঠাণ্ডা মাথায় সব কিছু ভাল করে দেখেশুনে তবেই সে তার মতামত প্রকাশ করে থাকে। গোড়ায় এই নিগার-দ্বীপ সম্পর্কে তার মধ্যে কোন আগ্রহই দেখা যায় নি। অথচ ঘটনাচক্রে সেই নিগার দ্বীপেই যেতে হচ্ছে তাকে শেষ পর্যন্ত। এবার আর শোনা কথা নয়, পরের মুখে ঝাল খাওয়া নয় একেবারে নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাওয়া। দেখা যাক এমন একটা সুযোগ হাতে পেয়ে ভেরা মনে মনে ঠিক করে ফেলে কিভাবে এই কেসটা নিয়ে গবেষণা চালাবে সে। সঙ্গে সঙ্গে সে আবার ভাবে, কি মহার্ঘ বস্তু লুকিয়ে আছে সেখানে কে জানে।
সত্যিই ভাগ্যটাও হেলাফেলা করার মতো নয়। আর ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে এমন একটা লোভনীয় চাকরী কজনেরই বা কপালে জোটে। সাধারণত ছুটির দিনের চাকরী মানেই তো এক গাদা বাচ্চাকাচ্চার ঝক্কি সামলান, চূড়ান্ত ঝামেলা।, সেসব কিছুই নয়। স্রেফ ছুটির দিনে সময় মাফিক হাজিরা দেওয়া। মিসেস ওয়েনের সেক্রেটারীর কাজ, ব্যস–ঐ পর্যন্তই।
বুদ্ধি করে একদিন এজেন্সিতে নামটা লিখিয়ে রেখেছিলাম। এখন তার সুফল ফলল। সেই এজেন্সি মারফতই তো এই সুখের চাকরিটা পাওয়া গেলো। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা চিঠিখানা, চিঠির প্রতিটি শব্দ যেন আমার মনের মত, তাই বোধহয় গেঁথে গেছে মনে, স্পষ্ট এখনো–
মহিলা এজেন্সি সুপারিশে আপনাকে একটা চাকরির খবর দিচ্ছি। আপনার উপযুক্ত বেতন আপনি পাবেন। প্যাডিংটন স্টেশন থেকে বারোটা চল্লিশের ট্রেন ধরে ওকব্রীজ স্টেশনে নামবেন। সেখান থেকে অপলকে আপনার চাকুরী স্থলে নিয়ে আসার জন্যে আমার একজন প্রতিনিধি থাকবে। এই চিঠির সঙ্গে আপনার রাহা-খরচ বাবদ এক পাউণ্ডের নোট মোট পাঁচ পাউণ্ড পাঠালাম।
আপনার বিশ্বস্ত
উনা নানসি ওয়েন
চিঠিতে প্রেরকের ঠিকানা লেখা ছিল নিগার আইল্যাণ্ড স্টিকলহ্যাভেন, ডিভন।
নতুন চাকরীর খবরটা পেয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা গেল। এই মাসটা স্কুলের ছুটি, একটা মাস কি করে কাটাবো, ভাবতে ভাবতে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। এরই মাঝে চিঠিটা ভাগ্যিস এলো। তা এই চাকরীটা মনের মত হলে বরাবরের জন্য এখানেই থেকে যাবো। এখানে স্কুলের খেলাধূলো বিভাগের চাকরীটা যে মন আর তেমন টানে না। যা বেতন তাতে পুরো মাসের না মেটে খরচ না ভরে মন। এক এক সময় তো বড় বিরক্তিকর বলে মনে হয় এই চাকরীটা।