অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে চিঠিটা দেখলেন ওয়ারগ্রেভ। পড়া শেষে মুখ তুলে তাকালেন তিনি, দেখছি চিঠির ওপরে রিৎজ হোটেলের ঠিকানা লেখা আছে। আর চিঠিটাও টাইপ করা, কালির আঁচড় টানা নেই কোথাও।
দেখি চিঠিটা একবার। এরকম ছিনিয়েই নিলেন ব্লোর চিঠিখানা। চিঠির প্রতিটি অক্ষরের উপর তার সতর্ক দৃষ্টি ঘোরাফেরা করে। হ্যাঁ একেবারে নতুন করোনেশান টাইপ মেশিনে টাইপ করা চিঠি। কাগজখানাও বেশ দামী। না, শুধু চিঠি দেখে এর বেশী কিছু
আড়চোখে ব্লোরকে একবার নিরীক্ষণ করে নিলেন ওয়ারগ্রেভ। তারপর এটু নড়েচড়ে বসলেন তিনি, চকিতে একবার সকলের মুখের ওপর দৃষ্টি বোলালেন, একটু কেশে নিয়ে বললেন এ সবের পর আমার মনে হয়, আমাদের এখনো চুপচাপ বসে থাকাটা ঠিক হবে না। কিছু একটা করতেই হবে। তবে তার আগে এখানে আসার ব্যাপারে আপনারা যে যেটুকু জানেন, বলুন। মনে কোন দ্বিধা রাখবেন না, সংকোচ করবেন না। জানার অনেক কিছুই বাকী আছে এখনো। ঘটনাক্রমে আমরা সবাই মিঃ ওয়েনের অতিথি হয়ে এসেছি এখানে। তার সঙ্গে যোগাযোগ পর্ব কি করে সম্ভব হলো, সেটা এখন খতিয়ে দেখতে হবে।
তারপরেই অখণ্ড নীরবতা।
মিস এমিলি ব্লেন্ট মুখ তুললেন, তিনিই প্রথম সেই নীরবতা ভঙ্গ করলেন, দেখুন আমার ব্যাপারটা আগাগোড়াই কেমন যেন গোলমেলে। কদিন আগে ডাকে একখানা চিঠি পাই। সেইটা এমনি দুর্বোধ্য যে, প্রেরকের নাম বোঝার উপায় ছিলো না। তবে চিঠিটা ছিল একজন মহিলার। দুতিন বছর আগে গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে গিয়ে কোথাও হয়তো দেখা হয়ে থাকবে তাঁর সঙ্গে। নাম মনে নেই-মিস্ ওরডেন কিংবা মিসেস অলিভারও হতে পারেন, কারণ বেড়াতে গিয়ে এ দুজন মহিলা ছাড়া আর কারোর সঙ্গে আমার আলাপ হয়নি। বিশেষ করে মিসেস ওয়েন নামের কারোর সঙ্গে তো নয়ই।
তা সেই চিঠিখানা দেখতে পারেন?
হ্যাঁ পারি বৈকি। একটু অপেক্ষা করুন আমি এখুনি আসছি, ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন মিস ব্লেন্ট। মিনিট খানে পরেই আবার ফিরে এলেন তিনি চিঠি হাতে নিয়ে।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চিঠিটা পড়লেন ওয়ারগ্রেভ। আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বিজ্ঞের মতো বললেন তিনি ব্যাপার একটু একটু করে পরিস্কার হচ্ছে, তবে মেঘ এখনো পুরোপুরি কাটেনি। মিস ক্লেথর্ণের দিকে ফিরে বললেন তিনি, এবারে আপনি বলুন।
সেক্রেটারীর চাকরীটা প্রাপ্তির ব্যাপারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব ঘটনাই বলে গেলো ভেরা এক এক করে।
তার কথা শোনার পর মার্স্টানের দিকে ফিরে বললেন ওয়ারগ্রেভ। আর ডঃ আর্মস্ট্রং আপনি? আপনি এসেছেন কেন এখানে?
চিকিৎসক হিসেবে।
এ বাড়ির কর্তার সঙ্গে আপনার কি আগে থেকেই পরিচয় ছিলো?
না, একেবারেই নয়। তবে চিঠিতে আমার এক সহকর্মীর নামের উল্লেখ ছিলো।
আর সেই সহকর্মীটির সঙ্গে বহুদিন আপনার কোন যোগাযোগ নেই এই তো?
ও হ্যাঁ, সেই রকমই বটে।
ঠিক আছে, এবার অন্য দিকে মুখ ফেরালেন ওয়ারগ্রেভ, জেনারেল ম্যাকআর্থার এবার আপনার যা বলার আছে বলুন।
নতুন করে বলার কিছু নেই, প্রত্যুত্তর বললেন ম্যাকআর্থার খোদ মিঃ ওয়েনের চিঠি পেলাম, চিঠিতে পুরনো বন্ধুদের নাম উল্লেখ ছিলো, তাদেরও নাকি এই দ্বীপে আসার কথা, তাই চলে এলাম, এই আর কি।
এবার আপনি বলুন মিঃ লম্বার্ড।
আ-আমি? আমতা আমতা করে নিজের মনে মনে ভাবলো লম্বার্ড, আসলে কথাটা এই মুহূর্তে বলা যাবে না এখানে। বললে পরে পস্তাতে হবে। তাই সহজ ভাবে বললে সে চিঠি পেলাম চলে এলাম। এক সময় মিঃ ওয়েনের সঙ্গে আলাপ হয়েছিলো, তাই
এবার ব্লোরের পালা। ডান হাতটা গালের ওপর স্থাপন করে শান্ত এবং দৃঢ় স্বরে বললেন ওয়ারগ্রেভএখন এই অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে দিয়ে আমাদের সময় কাটছে। এই তো একটু আগে এক অদৃশ্য কণ্ঠস্বর নাম উল্লেখ করে আমাদের সকলের অপরাধের ফিরিস্তি দিয়ে গেলো এক এক করে। সে যাইহোক, অভিযোগগুলোর কথায় পরে আসছি। তবে এই মুহূর্তে অতি তুচ্ছ হলেও অতি প্রয়োজনীয় একটা সমস্যার সমাধান না করে স্বস্তি পাচ্ছি না। যে দশজনের নাম একটু আগে উল্লেখিত হলো, তাদের মধ্যে উইলিয়াম হেনরি ব্লোর একজন। কিন্তু আমি যতটুকু জানি, আমাদের মধ্যে ব্লোর নামে কেউ নেই। একজন বটে, তবে তার নাম ডেভিস। এখন বলুন মিঃ ডেভিস, আপনার কি বলার আছে?
আপনি একজন বিচক্ষণ বিচারপতি, আমি ধরা পড়ে গেছি। ব্লোরের ঠোঁটে স্লান হাসি তাই এখন আর স্বীকার করতে বাধা নেই, আমি হ্যাঁ আমিই সেই ব্লোর উইলিয়াম হেনরি ব্লোর।
উনি যে এখানে শুধু নাম ভাড়িয়ে এসেছেন তা নয়, ওঁর অনেক গুণকীর্তন আছে। ব্লোর এর দিকে সরাসরি তাকিয়ে লম্বার্ড এবার তীক্ষ্ণ স্বরে আক্রমণ করলে তাকে, আপনি প্রতারক, আপনি প্রবঞ্চক। খানিক আগে কথা প্রসঙ্গে আপনি বলেছিলেন, আপনি নাকি জন্ম থেকেই নাটালে কাটিয়েছেন। সে কথাও ডাহা মিথ্যে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি জন্ম থেকে তো দূরের কথা জীবনে একটি দিনের জনেও আপনি নাটালে যাননি।
যেন একটা শক্তিশালী বোমা ফাটালো লম্বার্ড। আটজোড়া চোখের জ্বলন্ত দৃষ্টি গিয়ে পড়লো ব্লোরের উপর। মার্স্টানের রক্ত বোধহয় আরো একটু বেশী গরম, ব্লোরের দিকে ছুটে গেলো সে ঘুষি বাগিয়ে কি সত্যবাদী কি জবাব দেবেন এখন?
তাতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই ব্লোরের। তেমনি চেয়ারে পিঠ এলিয়ে ঘরের ছাদের দিকে চোখ তুলে জবাব দিলেন তিনি আপনারা ভুল করছেন। আমি জানি আমার সম্পর্কে এখানে আসার মুহূর্তে থেকেই একটা বাজে ধারণা করে নিয়েছেন। এর পর আমি আর কেবল নীরব শ্রোতা হয়ে বসে থাকতে পারি না, সত্যি কথাই বলছি শুনুন-আমি একজন অবসর প্রাপ্ত সরকারী গোয়েন্দা, প্লিমাউথে আমার একটা এজেন্সী আছে। এই কাজে আমাকে নিয়োগ করা হয়েছে বলেই আমি এখানে এসেছি, তা না হলে আসতাম না।