ঘর থেকে পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতে না যেতেই প্রথমে ভেরাই চিৎকার করে উঠলো, কিন্তু কার সেই কণ্ঠস্বর?
ঠিক বুঝতে পারছি না, একবার চারদিক তাকিয়ে দেখে নিয়ে বললেন ম্যাকআর্থার। কি সব উপদ্রব যে শুরু হলো এখানে। অতিথিদের এখানে নিমন্ত্রণ করে ডেকে এনে কত্তাটির এ কেমন রসিকতা? শেষের দিকে তার গলার স্বর কেঁপে উঠলো।
দেখে মনে হলো রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন ব্লোর, কিন্তু আসলে তার মুখের অসহায় ভাবখানি রুমাল দিয়ে ঢাকতে চাইলেন।
কোন অবান্তর লক্ষ্য করা গেলো না কেবল দুজনের মিঃ ওয়ারগ্রেভ ও মিস ব্লেন্টের। দুজনেই স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় প্রত্যক্ষ করতে থাকলেন ঘটনাটি।
আর্মস্ট্রংয়ের হাতে ইথেলের দেখাশোনা করার ভার তুলে দিয়ে এবার মুখ খুললো লম্বার্ড, আচ্ছা, কথাগুলো ও-ঘর থেকেই ভেসে এলো বলে মনে হলো না?
কিন্তু তাই বা কি করে সম্ভব? তার কথার জের টেনে বললো ভেরা, তখন আমরা সবাই তো-ঘরেই ছিলাম।
তাই তো খুব চিন্তায় পড়লো লম্বার্ড। ঘরের চারপাশে দৃষ্টি ফেলতে গিয়ে হঠাৎ ফায়ার প্লেসের পাশের একটা ছোট্ট দরজার উপর তার দৃষ্টি আটকে গেলো। ঐ দরজা পথে অনায়াসেই পাশের ঘরে যাওয়া যায়।
কথাটা মনে হতেই দ্রুত পায়ে ছুটে গেলো দরজার দিকে। তারপর দরজার হাতল ধরে, সজোরে টান দিতেই খুলে গেলো পাল্লা আর ওপাশের ঘরের দিকে বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে তাকিয়েই অস্ফুটে ছোট্ট একটি শব্দ বেরিয়ে এলো তার ঠোঁট কাঁপিয়ে ওটা কি?
ইতিমধ্যে তাকে অনুসরণ করে হাজির হয়েছিলেন সবাই, কেবল মিস্ ব্লেন্ট ছাড়া তিনি তেমনি নির্লিপ্তভাবে বসে রইলেন।
পাশের ঘরে প্রবেশ করার প্রয়োজন হলো না, বাইরে থেকেই সবাই স্পষ্ট দেখলেন সেই যন্ত্রটি একটি সাবেকি চোঙওলা গ্রামাফোন। একটা রেকর্ড ডিস্কের ওপরে, তখনো ঘুএছিল ডিস্কটা। চারটি ছোট গর্ত দেয়ালে, রেকর্ডের কথাগুলো এই গর্তগুলোর ভেতর দিয়ে এসেই এপাশের ঘরের অতিথিদের চমকে দিয়েছে।
ঝুঁকে পড়ে সাউণ্ড-বক্সের পিনই রেকর্ডের প্রথম দাগটার উপর রাখা মাত্র সেই অদৃশ্য মানুষটির বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বর আবার জেগে উঠলো এপাশের ঘরে। উপস্থিত ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলাগণ দয়া করে আপনারা একটু শান্ত হয়ে মন দিয়ে আমার কথাগুলো শুনুন–
দয়া করে বন্ধ করুন, আর শুনতে চাই না, উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল ভেরা। সঙ্গে সঙ্গে গ্রামাফোনের বোতাম টিপে বন্ধ করে দিলো লম্বার্ড।
এতোক্ষণ ডঃ আর্মস্ট্রং যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন, উঃ এমন বীভৎস রসিকতা জীবনে এই প্রথম দেখলাম।
তার মানে এই প্রথম মুখ খুললেন ওয়ারগ্রেভ। ওটাকে আপনি কি স্রেফ রসিকতা বলেই ধরে নিলেন?
এ ছাড়া, আর কি ভাবতে পারি?
ঠিক আছে, তবে এব্যাপারে এখনি আমি আমার মতামতটা জানাতে চাই না।
রাখুন আপনার মতামত।
মধ্যে কে গিয়ে এ-গ্রামাফোনটা চালিয়ে এসেছিলেন?
হু আমার প্রশ্নও তাই, বাকী অতিথিদের মুখের ওপরে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বললেন অভিজ্ঞ বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ আগে এর উত্তরটা জানা দরকার।
এই সব ব্রাণ্ডির গ্লাস হাতে বসবার ঘর প্রবেশ করলেন রগার্স। স্ত্রীর কানের কাছে মুখ নামিয়ে এনে উদ্বিগ্ন স্বরে শুধালো রগার্স, ওঠো, ওঠো ইথেল … এখন তুমি কেমন বোধ করছে ইথেল?
তার ডাক শুনে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো মিসেস রগার্স, তার দৃষ্টি ছাদের দিকে উদ্ভ্রান্ত। কথা বলল না সে।
আরো একটু চিন্তিত হয়ে এবার সে তার প্রায় কানের ওপর ঠোঁট রেখে জিজ্ঞেস করলো রগার্স কথা বলো ইথেল চুপ করে থেকো না প্লিজ
ডঃ আর্মস্ট্রং এগিয়ে গিয়ে মিসেস রগার্সের একখানি হাত তুলে নিয়ে নাড়ি টিপে বলে উঠলেন ভয়ের কিছু নেই এখন আর। ইথেলের উদ্দেশ্যে তিনি এবার বললেন, একটু চেষ্টা করলেই তুমি ঠিক উঠে বসতে পারবে, চেষ্টা করো
কিন্তু আমার কি হয়েছে? এভাবে আমাকে শুইয়ে রেখেছেনই বা কেন? আর্মস্ট্রংয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো ইথেল।
কিছুই হয়নি তোমার, মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলে।
হ্যাঁ, এবারে মনে পড়েছে তার চোখ দুটি আবার কি যেন খুঁজে ফেরে, আর মন যেন বলে উঠে, আমার কিছু হয়নি, উনি বললেই হলো নাকি। আমি যে নিজের কানে শুনেছি, সেই ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বর, সেই মারাত্মক অভিযোগ, অদৃশ্য মানুষটি আমাদের অপরাধের বিচার করছিলেন। কিন্তু আমাদের কি অপরাধ? তারপরেই ইথেনের চোখের পাতা বুজে গেলো। জোরে জোরে নিশ্বাস টানতে থাকলো, বেশ বোঝা যাচ্ছিল তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।
কই ব্রাণ্ডির গ্লাসটা দেখি। হাত বাড়ালেন আর্মস্ট্রং। ব্র্যাণ্ডির গ্লাসের সবটুকু পানীয় গলধঃকরণ করার পর ইথেলের মুখের ফ্যাকাসে ভাবটা কেটে গিয়ে তার মুখের ওপর আগের মতো আবার গোলাপী আভা ফুটে উঠতে দেখা গেলো। এবং স্বাভাবিক স্বরেই বললো সে এবার আর আমার কোন কষ্ট নেই, সম্পূর্ণ সুস্থ আমি এখন। তবে সেই বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বরটা শুনে ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।
তা ঘাবড়াবারই তো কথা। তার মুখের কথাটি কেড়ে নিয়ে গার্স বলে উঠলো, ওঃ তার সেই সব অভিযোগগুলোর ভাষাই বা কি ভয়ঙ্কর। শুনে তো ভয়ে আমার হাত থেকে ট্রেটাই পড়ে গেলো। যতো সব–সে হয়তো আরো কিছু রলতো কিন্তু পারলো না। শেষ শব্দটা তার মুখ থেকে উচ্চারিত হওয়ার পরমুহূর্তেই কে যেন কাশলেন সঙ্গে সঙ্গে থামলো সে। কাশির শুকনো খক্ খক্ একটা শব্দ, আর তাতেই থামতে হলো তাকে।