হ্যাঁ একটুও বাড়িয়ে বলা নয়, তবে যে দুজন কাজের লোককে পেয়েছেন মিসেস, অলিভার রগার্স আর তার স্ত্রীর কথাই ধরা যাক না কেন। রগার্সের বৌ-এর যেমন মিষ্টি হাত, তেমনি মিষ্টি মুখ। হাসি যেন লেগে আছে সব সময়।
সে কি মিসেস অলিভার কি বলছেন? যাঃ এরই মধ্যে নামধাম সব ভুলে বসে আছেন। এ যেন বুড়ো বয়সে ভীমরতি।
মুখ টিপে হাসি চাপলো ভেরা, হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন মিসেস ওয়েন সত্যিই একজন ভাগ্যবতী মহিলা বটে।
মিসেস ওয়েন? অবাক চোখে তাকালেন এমিলি যেন এই প্রথম নামটা শুনছেন তিনি।
কেন উনিই তো এ বাড়ির সব কিছু। এ বাড়ির কর্ত্রী।
এই সময় দরজা ঠেলে বাকী অতিথিরা সবাই এক এক করে ঢুকলো এ ঘরে।
এমিলির পাশের খালি চেয়ারটি দখল করলেন ওয়ারগ্রেভ। ভেরার ঠিক উল্টো দিকে বসলেন আর্মস্ট্রং। ব্লোর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফায়ার প্লেসের ওপরকার ব্রোঞ্জের একটি সুদৃশ্য মূর্তি নিরীক্ষণ করতে থাকেন। একটা চেয়ারে দেহখানি এলিয়ে দিয়ে একখানা বই-এর পাতা উল্টাতে থাকলেন, ওয়ারগ্রেভ আর ম্যাকআর্থার দেওয়ালে পিঠ দিয়ে সিগার ধরালেন।
কফির ট্রে থেকে যে যার কফির কাপ তুলে নিলো। নৈশভোজের পর কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে গিয়ে সবার মুখে একটা পরিপূর্ণ তৃপ্তির ভাব ফুটে উঠতে দেখা গেলো, এখানকার আতিথেয়তার ব্যাপারে সবাই মুগ্ধ।
ওদিকে রাত্রি গড়িয়ে চলে একটু একটু করে। ঘড়ির কাঁটা একটু একটু করে। ঘড়ির বঁটা দুটি থেমে নেই, চলছে টিক টিক শব্দ করেনটা বেজে কুড়ি।
আর ঠিক তখনি হঠাৎ ঘরের নিস্তব্দতা ভেঙে রেণু রেণু করে গুঁড়িয়ে দিয়ে একটা ব্ৰজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বর ধাক্কা খেতে থাকলো ঘরের এ-দেওয়াল থেকে ও-দেওয়ালে। অলক্ষে বলা সেই গায়ের লোক খাড়া করা কণ্ঠস্বর-উপস্থিত ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলাগণ দয়া করে আপনারা একটু শান্ত হয়ে মন দিয়ে আমার কথাগুলো শুনুন।
স্তব্ধ, হতবাক সবাই, ওর মুখের দিকে তাকালেন, ভাবখানা এই যে ব্যাপারটা কারোর জানা আছে কি না। সেই ঘরের দরজার জানালাগুলোর দিকেও তাকালেন তারা, যদি সেখানে দেখা যায় কোন অপরিচিত মুখ, যে কিনা–না, কাউকেই তো চোখে পড়লো না। তাহলে কে–কে কথা বললো অমন করে?
তাদের ভাববার জন্য একটু সময় দিয়ে ভেসে উঠলো আবার সেই বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বর, অতিথিদের উপস্থিতিতে প্রচণ্ড বিদ্রূপ করে সেই অদৃশ্য মানুষের কণ্ঠস্বর ঘরের চার দেওয়ালে অণুরণিত হয়ে ফিরতে থাকলো বিধাতার অমোঘ বিধানের মতো।
তাহলে এবার খোলাখুলি ভাবেই বলি, আমার বিচারে আপনারা প্রত্যেকেই কেউ না কেউ এক একটি অপরাধের আসামী। আপনাদের অপরাধগুলো শুনুন তাহলে
এডওয়ার্ড জর্জ আর্মস্ট্রং আপনার মনে পড়ে, ১৬ই মার্চ ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে আপনি লুইজা মেরী ব্লিজের মৃত্যুর জন্য দায়ী আপনিই।
এমিলি ক্যারোলিন ব্লেন্ট, ৫ই মার্চ ১৯৩১ খৃস্টাব্দে বেট্রিস টেইলরের মৃত্যুর জন্য আমি আপনাকেই দায়ী করছি।
ফিলিপ লম্বার্ড, তারিখটা ঠিক আমার মনে নেই তবে ১৯৩২ খ্রীস্টাব্দে ফেব্রুয়ারী মাসের কোন এক তারিখে পূর্ব-আফ্রিকার একুশজন আদিবাসিকে ভয়ঙ্কর নৃশংস ভাবে হত্যা করার অপরাধে আমি আপনাকেই অভিযুক্ত করছি।
আচ্ছা জন গোরদোন ম্যাকআর্থার বলুন তো কেন আপনি ১৪ই জানুয়ারি ১৯১৭ খৃষ্টাব্দে দারুণ বুদ্ধি কাটিয়ে আপনি আপনার স্ত্রীর প্রেমিক আর্থার রিচমণ্ডকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন?
অ্যান্টনি জেমস মার্স্টান গত নভেম্বরের ১৪ তারিখে আপনার জন্যই জন কোম্বস ও লুসি কোম্বসকে মৃত্যুবরণ করতে হয়।
টমাস রগার্স আর ইথেল রগার্স আর মনে পড়ে ৬ই মে ১৯১৯ খৃস্টাব্দে মিস্ জেনিফার ব্র্যাডি কার হাতে খুন হয়েছিলেন? হা, হা আপনাদের হাতেই।
আর শেষ অভিযোগ হলো লরেন্স জন ওয়ারগ্রেভের বিরুদ্ধে ১০ই জুন ১৯৩০ খৃস্টাব্দে এডওয়ার্ড সিটনের মৃত্যুর জন্য মূলতঃ দায়ী।
উপস্থিত অপরাধীগণ আপনাদের বিরুদ্ধে আমার অভিযোগগুলো তো শুনলেন আমার তো মনে হয় না আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আপনাদের কোন বক্তব্যই থাকতে পারে, থাকতে পারে কি?
নীরব হল সেই ভয়াবহ কণ্ঠস্বর। সেই সঙ্গে ঘরে নেমে এল বুক নিস্তব্ধতা। সেই অদৃশ্য মানুষের বজ্রগম্বীর স্বর বন্ধ হয়ে গেলেও রেশটুকু যেন অণুরণিত হয়ে ফিরতে থাকলো ঘরের মধ্যে।
আর সেই নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে খান্ খান্ করে একটা কান্নার শব্দ উঠলো। শব্দটা কোত্থেকে আসছে দেখার জন্য চোখ তুলে তাকালেন সবাই এদিক ওদিক, রগার্সের হাত থেকে কফির ট্রেটা পড়ে যাওয়ার শব্দ
ঠিক তখনি ঘরের বাইরের কোন কান্নারত নারী আর্তনাদ করতে করতে যেন মাটির ওপরে লুটিয়ে পড়লো।
প্রথমে লম্বাৰ্ড ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে এলো বাইরে। মিসেস রগার্সকে বারান্দায় পড়ে থাকতে দেখলো সে। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠলো সে মিঃ মার্স্টান তাড়াতাড়ি একবার বাইরে আসুন তো।
দুজনে মিলে ধরাধরি করে ইথেল রগার্সের অচৈতন্য দেহটা বহন করে নিয়ে এলো বসবার ঘরে। শুইয়ে দিলো একটা সোফার উপরে।
ডঃ আর্মস্ট্রং রুগিনীর নাড়ি পরীক্ষা করে জানিয়ে দিলেন ভয়ের কিছু নেই, দু, এক মিনিটের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে পাবে।
জলদি একটু ব্রাণ্ডি নিয়ে এসো তো, রগার্সের দিকে ফিরে বললল লম্বার্ড।
কাজগের মতো সাদা ফ্যাকাসে মুখ করে বললো রগার্স হ্যাঁ এখুনি নিয়ে আসছি স্যার।