এই মুহূর্তে ম্যাকআর্থারকে দেখলে ভয়ডরহীন লোক বলে মনে হবে। রাগে-উত্তেজনায় তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছিল। আগে জানলে কেউ কি সেধে এখানে আসতো। এ যেন উল্টোপুরানের দেশে এসে পড়লাম,এখানকার সব কিছুই যেন উল্টো। যিনি আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ডেকে নিয়ে এলেন এখানে, আশ্চর্য তিনিই অনুপস্থিত। ফিরে যে যাবো, তারও কোন উপায় নেই, আর এখন, লঞ্চটা সেই যে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো, তারপর তার আর কোন পাত্তা নেই। এ যেন এক গভীর ষড়যন্ত্র। আমার বিরুদ্ধে একটা সুপরিকল্পিত চক্রান্ত দেখছি এখানে, রাত্রিবাস না করে উপায় নেই।
আর অন্য সব অতিথিদের সঙ্গে প্রাণখুলে যে একটু কথা বলবো তারও যো নেই। সবাইকে এখনো দেখার সুযোগ না হলেও ঐ যে লম্বার্ড, লোকটাকে একবার দেখেই কেন জানিনা আমার মনে হয়েছে, ঠিক সুবিধের নয় সে। আমার আশঙ্কা লোকটা না আমাদের উটকো ঝামেলায় ফেলে দেয়?
নৈশভোজের ঘণ্টা পড়তেই নড়ে-চড়ে উঠলো লম্বার্ড। ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির ধাপগুলো গুণে গুণে নিচে নামতে শুরু করলো। তার পায়ে ছিলো হাল্কা রবার সোলের জুতো, তাই একটুও শব্দ হল না, তার একটুও শব্দ হল না, তার চলার ভঙ্গি দেখে মনে হলো শিকারের সন্ধানে অতি সন্তর্পণে পা টিপে টিপে চলেছে একটা কালো চিতা আর ঠোঁটে একটা অদ্ভুত রহস্যময় হাসি।
সাত সাতটা দিন, বেশ ভালভাবেই কাটবে বলে মনে হয়।
চোখের দৃষ্টিতে একটা আনমনা ভাব মিস্ এমিলি ব্লেন্টের, পরণে কালো সিল্কের গাউন, বিছানায় শায়িত অবস্থায় হাতে একখানি বাইবেল নিয়ে তিনি তখন মৃদু কণ্ঠে পড়ে চলেছেন
নৈশভোজের ঘন্টা পড়তেই বাইবেল মুড়ে রেখে উঠে দাঁড়ালেন মিস্ ব্লেন্ট। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন ডাইনিং রুমে।
.
০৩.
এক সময় নৈশভোজ শেষ হলো। রান্না বেশ ভাল মিসেস রগার্সের। খেয়ে সকলেই
আবার পানীয়, রীতিমতো পুরানো মদ, এবং সুস্বাদু। দুএক পেগ পেটে পড়তেই সবাই বেশ চাঙ্গা। সবার মনের মেঘ তখন কেটে গেছে, বাধা সরে গেছে অপরিচিতের। মেতে উঠেছে গল্প-গুজবে।
সব থেকে সতেজ সজীব যেন বৃদ্ধ ওয়ারগ্রেভ, কয়েক মিনিটে তার বয়েস যেন অর্ধেকে নেমে এসেছে। কথার ফুলঝুরি ফুটছে তার মুখে, চমকদার সব গল্প–ডঃ আর্মস্ট্রং এবং টনি মার্স্টান এখন তার প্রধান শ্রোতা। ওদকে মিস ব্লেন্ট ও জেনারেল ম্যাকআর্থারের জুটিও কমতি যায় না। আর ভেরাও চুপ করে বসে থাকে না। দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাপারে তার প্রচণ্ড কৌতূহল, একের পর এক প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে চলেছে সে ডেভিসকে, তুখোড় ডেভিস তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে গড়গড় করে। আর প্রশ্নোত্তর পর্ব বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে লম্বার্ড মুদিত নয়নে।
হঠাৎ টেবিলের ওপর রাখা একটি কাঁচের ওপর চোখ পড়তেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মার্স্টান, দারুণ চমৎকার পুতুলগুলো তো সঙ্গে সঙ্গে তার দৃষ্টি অণুসরণ করে বললো ভেরা কি আশ্চার্য। এতক্ষণে চোখে পড়েনি তো আমার আপনাদের কারোরই নয় বোধ হয়। আর কতগুলো পুতুলই বা–এক, দুই, চার, ছয়, আট, দশ দশ দশটি কুচকুচে কালো রঙের পুতুল, কালোমাণিক, কালো নিগার। দেওয়ালের টাঙ্গানো সেই কবিতাটির কথা মনে পড়ে গেলো তার দশটি কালোমানিক কালো সোনা।
জানেন, পুতুলগুলোর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে অতিথিদের দিকে ফিরে তাকালো ভেরা, আমার ঘরের দেওয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো একটা অদ্ভুত কবিতা আছে কবিতাটির প্রথম কটা লাইন, হা এবারে মনে পড়েছে দশটি কালো হীরে-সুর করে পড়তে ভারী ভালো লাগে।
এ আবার নতুন কি এমন কথা। সবজান্তার মতো মৃদু হেসে সঙ্গে সঙ্গে লম্বার্ড বলে উঠলো, ও কবিতা আমারো পড়া, আমার ঘরের দেওয়ালেও টাঙ্গানো আছে।
আমারও! আমারও! আমারও! আমারও! প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠলেন উপস্থিত সকলে।
ভেরার ঠোঁটে হাসি এরই নাম শখ। বুঝলেন শখ। কবিতা লিখবো অমনি হাতের কলমে বেরিয়ে এলো কবিতাটা প্রচার করতে হবে, তাই সেই কবিতাটার এক একটা নকল টাঙ্গিয়ে দেওয়া হলো প্রতিটি ঘরের দেওয়ালে মেহগনি কাঠের ফ্রেমে এঁটে। একেই বলে ধনী লোকেদের অদ্ভুত খেয়াল।
আরে না না ওসব কিছু নয়। স্রেফ ছেলেমানুষী আর কি। বুড়ো খোকার বয়স ভাড়িয়ে বিদ্যের বহর দেখানো।
হাসছেন ওয়ারগ্রেভ, সেই ফাঁকে মদের গ্লাসে ঘন ঘন চুমুক দেওয়ার কথাটি ভোলেন নি তিনি।
ভেরার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো এমিলির। চোখে চোখে কি যে কথা হলো তাদের কে জানে। তবে পরক্ষণেই উঠে দাঁড়িয়ে বসবার ঘরে চলে গেলেন তারা।
গরাদবিহীন সব জানালা। সমুদ্র ঝড় উঠেছে, স্পষ্ট দেখা গেলা বসবার ঘর থেকে ঝড়ো বাতাস পাহাড়ের গায়ে আছড়ে পড়ে এক একটা বিকট শব্দ তুলছে।
সেই প্রাকৃতিক দৃশ্যের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে চোখে উদাস দৃষ্টি ছড়িয়ে বললেন এমিলি অপূর্ব।
যাই বলো তুমি, সমুদ্রের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো ভেরা, সমুদ্র আমার একেবারেই ভাল লাগে না।
তার কথা শুনে এমিলি তো অবাক। বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ পাল্টালো ভেরা, আমি কিন্তু ভুল বলিনি, এই ধরুন না, আমাদের এই নিগার দ্বীপের কতা। এভাকে সমুদ্রে ঝড়ের দাপাদাপি চলতে থাকলে আমাদের অবস্থা কি দাঁড়াতে পারে। সে কথা কি ভেবে দেখেছেন একবারও? কতো রকম অসুবিধেই না হতে পারে। চাকর-বাকরদের ঠিক সময়ে পাওয়ার জো নেই, এখন একবার স্টিকলহ্যাভেনে যেতে হবে-যদি দয়া করে কেউ আসেন তবেই স্বস্তি, আপনার আনন্দ।