কিন্তু কি আশ্চর্য এই পাণ্ডববর্জিত নির্জন দ্বীপে মরতেও যেখানে কেউ আসতে চায় না, সেখানে এই বৃদ্ধ লোকটি এল কেন?
দূর থেকে আর্মস্ট্রংকে লক্ষ্য করেছিলেন ওয়ারগ্রেভ। কিন্তু তার মধ্যে তেমন কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলো না, একই ভাবে বসে রইলাম আরাম কেদারায়। তেমনি বসে থাকতে থাকতেই মনে পড়ে গেল অনেক অনেক দিন আগেরকার পুরনো একটা ঘটনার কথা–
ওঃ কি খেলাই না দেখিয়েছিল আর্মস্ট্রং। সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েও বিন্দুমাত্র টলেনি, অনড় অমল থেকে মাপা কথা দিয়ে মাপা যুক্তি দিয়ে সাক্ষ্য দিয়ে যায়। ভুল কিংবা কোন বেফাঁস কথা বলা নয় সব কথাতেই বুদ্ধির ছাপ স্পষ্ট ছিলো। ডাক্তারগুলো বিশেষ করে হারলি স্ট্রীটের ডাক্তারগুলোর বুদ্ধি শুদ্ধি যে একটু কম হয়, আমার অন্তত সেই রকমই জানা ছিল। এই তো কদিন আগে গিয়েছিলাম হারলি স্ট্রিটে হাতুড়ে ডাক্তার তার সঙ্গে দুচারটে কথা বলেই তার বুদ্ধির দৌড় যে কতদূর টের পেতে অসুবিধে হলো না। কিন্তু এই আমস্ট্রং ডাক্তারটি তাদের ব্যতিক্রম।
আর্মস্ট্রং কাছে আসতেই দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেল তার। কোন ভূমিকা না করেই তিনি বলে উঠলেন, সোজা হলঘরে চলে যান গ্লাস সাজানো আছে।
কি যে বলেন মশাই, এগিয়ে যেতে গিয়ে বললেন আর্মস্ট্রং, গ্লাসে চুমুক দেয়ার আগে বাড়ীর কর্তা গিন্নীকে অভিবাদন জানিয়ে আসতে হয় না।
সে গুড়ে বালি, ওয়ারগ্রেভের ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো, চোখ বুঝলেন দুজনের একজনও বাড়িতে নেই।
বিস্মিত হলেন আর্মস্ট্রং এরকম তো কথা ছিল না, যার আহ্বানে এখানে আসা তিনিই অনুপস্থিত। তার মুখ দিয়ে কথা বেরুলোনা।
আপনি লেডী কনস্টান্স কালসিংটনকে তেমনি চোখ বন্ধ রেখেই জিজ্ঞেস করলেন বৃদ্ধ চেনেন নাকি?
না মানে ঠিক বলতে পারছি না তবে ঐ নামের কাউকে যেন আমি ঠিক মনে করে উঠতে পারছি না,
তা মনে না রাখার মতোই একটা নাম বটে, তিনি তো আর বিখ্যাত কেউ নন। এক অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ তিনি, ভাল করে লিখতেও শেখেননি। কি যেন ছাই-পাঁস লিখলেন–এখন মনে হচ্ছে ভুল জায়গায় এসে পড়লাম না তো।
তারপর সেখানে আর দাঁড়ালেন না আর্মস্ট্রং, দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন হলঘরের দিকে।
এদিকে কালসিংটনের কথা ভাবতে গিয়ে অতিথিদের মধ্যে সেই দুজন মহিলার কথা মনে পড়ে গেলো ওয়ারগ্রেভের। একজন বেশ বয়স্ক, গম্ভীর, কথা একেবারেই বলেন না। আর অন্যজনের বয়স বেশ অল্প, কিন্তু এই অল্পবয়সী মেয়েদের আদৌ ভাল লাগে না তার। যুবকদের পাকিয়ে তুলতে ওস্তাদ যেন ওরা।
কিন্তু ওদের দেখতে পাচ্ছি না, গেলো কোথায় ওরা। এতো বড় প্রাসাদে মাত্র তিনজন তো মহিলা। মিসেস রগার্সকে মহিলাদের দলে রাখতে হচ্ছে কারণ কোন কারণেই ফেলনা নয় সে। তাছাড়া মিসেস রগার্সের ব্যাপার স্যাপারই যেন কেমন, ভয়ে আতঙ্কে তার চোখ মুখ কেমন বিবর্ণ, সিটকে আছে সব সময়। ভয়ে সিটকে থাকে নাকি ওটা ওর একটা ভাণ মাত্র।
রগার্স বোধ হয় কোন কাজে প্রাসাদের বাইরে এসে থাকবে। তার পায়ের শব্দ শোনা মাত্র চোখ মেলে তাকালেন ওয়ারগ্রেভ, এবং ব্যস্ত সমস্ত ভাবে জানতে চাইলেন, শোনো রগার্স লেডী কনস্টান্স কালসিংটনের এখানে আসার কোন খবর-টবর আছে তোমার কাছে?
আজ্ঞে না, কোন খবর তো নেই জোরে জোরে মাথা নেড়ে জবাব দিলো সে, এখানে আমার তালিকায় ওঁর নামই নেই।
সে কি? শুধু অবাক নয়, আহতও হলেন তিনি। বেদনাক্লান্ত চোখ দুটি তার আবার বুজে এলো ধীরে ধীরে।
বাথরুমে ঢুকেছিল মার্স্টান স্নান করার জন্যে। ফোয়ারার নিচে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে তপ্ত শরীরটা শীতল করতে চাইছিল সে। দীর্ঘ পথের ক্লান্তিতে শরীরটা কেমন নুইয়ে পড়েছিল। শীতল জলের স্পর্শে সে যেন আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলো। স্নান সেরে দাড়িটা কামিয়ে নিতে হয়। তারপরেই ককটেলের গ্লাসে চুমুক দেওয়া। রাত আটটায় নৈশভোজের পর আবার এক গ্লাস জবরদস্ত ককটেল।
কোন রকমে টাইটা গলায় ঝুলিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন মিঃ ব্লোর। নিজেই নিজের চেহারার প্রশংসা করে বিড়বিড় করে বললেন, দারুণ মানিয়েছে একজন কেস্ট বি বলে মনে হচ্ছে এবার। হ্যাঁ তা তো হতেই হবে। আজ আর কোন ত্রুটি রাখলে চলবে না। কিন্তু অন্য সব অতিথিদের রকম-সকম কি। সোজাসুজি আমার দিকে তাকাচ্ছে না কেউ। অথচ দেখার লোভটুকুও সামলাতে পারছে না, ঠাড়ে ঠাড়ে দেখছে, আর কি যেন আন্দাজ করার চেষ্টা করছে। ওদের চোখ তো তাই বলছে বলে মনে হয়। তবে কি কেউ আমার ব্যাপারে কিছু জেনে ফেলেছে?
জানুক গে, শেষ পর্যন্ত কি হয়। আমার সাফ কথা হলো, আমি কি ডরাই সখী ভিখারি রাঘবে। কাউকে ভয় করে তুরুপের তাসটা হাতছাড়া করবে না, সে বান্দা আমি নই। আমি শেষ দেখতে চাই-হাতের কাপলিং লাগিয়ে ঘরের বাইরে বেরুবার জন্যে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে তার দৃষ্টি আটকা পড়লো দেওয়ালের দিকে ফ্রেমে বাঁধানো তুলোট কাগজে লেখা একটি কবিতা ঝুলছে সেখানে। কবিতাটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার পর নিজের মনে তারিফ করলেন তিনি, খাসা লিখেছে, কবির হাত যথেষ্ট ভাল, ছন্দজ্ঞান টনটনে পড়তে মন্দ লাগে না। এইসব কালোমৌনবাদের দ্বীপে এসছিলেন এর আগে আর একবার, সেই কোন্ ছেলেবেলায়। তখন কে ভেবেছিলো এমন একটা উদ্ভট কাজে আবার আমাকে ফিরে আসতে হবে নিগার আইল্যাণ্ডে।